বাংলাদেশে মোট কয়টি রাজনৈতিক দল আছে, তার মধ্যে কয়টি নিবন্ধিত, কয়টি অনিবন্ধিত তার কোনো সঠিক তথ্য জনসমক্ষে নেই। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার প্রতিরোধ আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের পতনের পর দেশে নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অপরিসীম। নিজেদের দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা না থাকলে তারা দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কী অবদান রাখবেন? তদন্ত করলে দেখা যাবে দেশের নামী দামি অনেক রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নেই। দেশের ৫৩ টি দল ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হয়নি। ৫৩টি মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সহ ৬টি দলের নিবন্ধন বাতিল দেখা যায়। নির্বাচন কমিশনে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে অর্ধ শতাধিক রাজনৈতিক দল। নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী কয়েকটি দল ছাড়া বাকি সবই সাইনবোর্ড–সর্বস্ব। জাতীয় সংসদে এর বেশির ভাগেরই কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, ছিল না। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দল নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হলেও বড় বড় দলের অনীহার কারণে তা ভেস্তে যায়। ফলে বিষয়টি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়। আইনবিদদের সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিল, ব্যবসায়িক সংগঠন নিয়ন্ত্রণের জন্য চেম্বার কিংবা এফবিসিসিআই রয়েছে, লেবার অর্গানাইজেশনগুলো তদারকির জন্য সরকারের লেবার ডাইরেক্টর আছে, কোম্পানি–সংক্রান্ত বিষয় তদারকির জন্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো বিধি মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে কি না তা দেখার কেউ নেই। পতিত সরকারের আমলে মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন শুধু কমিশন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছে। এসব তদারকির জন্য নির্বাচন কমিশনের ওপর কঠোরভাবে কোনো দায়িত্ব আরোপ করা হয়নি। ফলে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য রাজনৈতিক সংগঠন। আমাদের দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রচর্চার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিবিদেরাই হচ্ছেন দেশের জনগণের প্রতিনিধি ও আইন প্রণেতা। দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব জনগণ তাদের হাতে ন্যস্ত করেন। গণতন্ত্রচর্চা, সুশাসন এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন, পরিচালনা ও নিবন্ধন সংক্রান্ত শক্তিশালী নীতিমালা এবং রাষ্ট্রীয় তদারকি অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে সর্বপ্রকার দলীয় কোন্দল, ক্ষমতার উদগ্র লড়াই, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগের অবসান হতে পারে। বন্ধ হতে পারে সর্বহারা, নকশাল, জেএমবির মতো উগ্র অশুভ শক্তির উত্থান। রাজনীতিতে যেন দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসন না হয় তার আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
১. রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(২) মতে রাজনৈতিক দল বলতে এমন একটি অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসংঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাইরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনো নামে কাজ করেন এবং কোনো রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ হতে পৃথক কোনো অধিসংঘ হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করেন ।
২. রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন: রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন, ২০২০ আইন অনুসারে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন হবে। উক্ত আইনের ২ (১৮) ধারা মতে ‘রাজনৈতিক দল’ অর্থ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(১) এ সংজ্ঞায়িত এবং এই আইনের ধারা ৪ এর অধীনে নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দল। ৪ ধারায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রদত্ত শর্তে যে কোন ২টি শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে। কমিশনের বিবেচনায় কোনো রাজনৈতিক দল শর্তাদি পূরণে ব্যর্থ হলে ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হবে ।
৩. রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে বাধা– ধারা ৫ অনুসারে (১) একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধীকরণের অযোগ্য হইবে, ক) উক্ত দলের গঠনতন্ত্রের উদ্দেশ্যসমূহ সংবিধানের পরিপন্থি হয়; বা খ) উক্ত দলের গঠনতন্ত্রে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা ও লিঙ্গ ভেদে কোনো বৈষম্য প্রতীয়মান হয়; বা গ) নাম, পতাকা, সীল বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ড দ্বারা ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক ঐক্য বিনষ্ট হইবার কিংবা দেশকে বিচ্ছিন্নতার দিকে লইয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে; বা ঘ) গঠনতন্ত্রে দলবিহীন বা একদলীয় ব্যবস্থা সংরক্ষণ বা লালন করিবার উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়; ইত্যাদি।
৪. নিবন্ধনের জন্য দরখাস্ত– আইনে স্পষ্ট উল্লেখ আছে– ধারা ৩ ও ৪ এ বর্ণিত শর্তসমূহ প্রতিপালনকারী ধারা ৫ এর অধীন অযোগ্য নয় এইরূপ কোন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য দলের প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব বা উহাদের সমপর্যায়ের পদাধিকারীর স্বাক্ষরে নির্ধারিত পদ্ধতিতে দরখাস্ত দাখিল করিতে পারিবে। ধারা ৭ (৩) মতে নিবন্ধন বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গণ্য হইবে।’
৫. নিবন্ধন বাতিল– নিবন্ধন বাতিল বিষয়ে ধারা ১১ বলা আছে– কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিম্নোক্ত কারণে বাতিল হইবে, যথা:- দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কমিটি, উহা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, কর্তৃক দলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হইলে কিংবা নিবন্ধন বাতিলের জন্য দলের প্রধান ও সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব বা উহাদের সমপর্যায়ের পদাধিকারী কর্তৃক দলীয় সিদ্ধান্তের কার্যবিবরণীসহ কমিশন বরাবর আবেদন করা হইলে; বা নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দল সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হইলে; বা এই আইন ও বিধিমালার অধীন কমিশনে প্রেরিতব্য কোন তথ্য পর পর তিন বৎসর প্রেরণ করিতে ব্যর্থ হইলে; বিলুপ্ত ঘোষিত নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দলের নাম অনুযায়ী অপর কোন দলকে নিবন্ধিত করা, বিলুপ্ত ও বাতিলকৃত নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হইবে।
৬. নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল– ধারা (১২) মতে কমিশন কর্তৃক কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ দল হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করা যাবে। তবে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা বা নিবন্ধন বাতিল করতে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ উক্ত আইনে নেই। উপরোক্ত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন কমিশন খতিয়ে দেখেছে বলে কোনো তথ্য মেলেনি। তবে বড় বড় রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন না থাকায় ছোট ছোট অনেক দলের আবেদনপত্র জমা পড়ে আছে এবং এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৩টি (৬টি বাতিল সহ) রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন রয়েছে মর্মে জানা গেছে। এ ব্যাপারে আমার অভিমত যেসব রাজনৈতিক দল পাঁচ বছরেও পার্লামেন্টে কোনো মেম্বার নির্বাচিত করে পাঠাতে পারেনি তাদের দলীয় অনুমোদন বাতিল করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে দেশে গণতন্ত্রের মুখরোচক স্লোগান দিলেও নিজেদের মধ্যে, গণতন্ত্র চর্চা নেই। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য অনেককে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিধি মোতাবেক চলছে কি না তার কঠোর তদারকির প্রয়োজন। আমি মনে করি এ ব্যাপারে পার্লামেন্টে ফ্লোর ক্রসিংয়ের বিধান বাতিলের দাবি জানাই। বর্তমানে ফ্লোর ক্রসিং করলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। গণতন্ত্র না থাকলে ঐ দলের অনুমোদন বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন থাকলে দলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে, যা গণতন্ত্র শক্তিশালী হতে সহায়ক হবে। সে জন্য রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনটি সংশোধন ও সংস্কার জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিবন্ধন করে দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে অনেকেই নারাজ। বড় দল দুটি একে অহেতুক ঝামেলা বলে মত প্রকাশ করেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম কত দিনে কতজন সদস্য ও কয়টি শাখা থাকতে হবে তার নিয়ম থাকতে হবে। দলের কমিটি গঠনে সদস্যদের মতামতের প্রতিফলন হতে হবে। তা ছাড়া রাজনীতিতে কালো টাকার মালিক, ঋণখেলাপি, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি, সাবেক আমলাদের প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির আইন করতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, নেতা ও কর্মীদের আয়–ব্যয়ের উৎস সম্পর্কে জনসমক্ষে সঠিক তথ্য পেশ করতে হবে। বিগত পতিত সরকারের আমলে কমিশনে রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন, ২০২০ এ কিছু সংশোধনী আনা হলেও দিনের ভোট রাতের কারিগর হিসাবে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন গণআস্থা হারিয়ে ফেলে। এসব আইনকে সংস্কার করে তা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। একই ব্যক্তি পর পর দু‘বারের বেশি যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন এবং দলীয় প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান যেন একই ব্যক্তি না হয় ও প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করার দাবিগুলো বিবেচনায় আনা দরকার মনে করছি।
লেখক : আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।