
স্বাধীনতার অর্ধদশক পর চট্টগ্রাম কলেজের লিচুতলায় কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে স্বপন সেনের সাথে আমার দেখা হয়। লিচুতলা হচ্ছে চট্টগ্রাম কলেজের রাজনীতি ও সংস্কৃতির ফোকাল পয়েন্ট। বিকেল তিনটার দিকে সব ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও রাজনীতি ও সংস্কৃতি কর্মীরা ক্যাম্পাসে থাকতো। লিচুতলার পথ ঘেঁষে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গার্লস কমনরুম, রেডবিল্ডিং ও লাইব্রেরি অপজিটে উঁচু সিঁড়ি ছিল হাইডপার্ক (বক্তৃতার মুক্তমঞ্চ) তালেবের কেন্টিন, হোস্টেলের পথে কৃষ্ণচূড়া এভিনিউ। আমাদের জীবন যৌবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়।
লিচুতলার স্টেজে স্বপন সেন গান করতো। কোরাস গানের পারফরমার হিসেবে তাকে দেখেছি। পরে জেনেছি বাংলা সকল ধ্রুপদী গান সে গাইতে পারতো। গায়ক, সুরকার সবার ইতিহাস তার মুখস্থ ছিল। চট্টগ্রাম কলেজে স্বপন সেনের সমকালে যারা গান গাইত, তাদের কিয়দংশ তালিকা হচ্ছে– এসএম সোলায়মান, বাংলা ডিপার্টমেন্টের ফরিদা বেগম হাসি, ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের কাজী আয়েশা আমান, আয়েশা খাতুন এ্যানি, শ্বাশতী দাশ, ইকোনমিকস–এর রত্না মজুমদার, সায়েন্সে ইন্টারমিডিয়েট সেকশনে শ্বাশতী বড়ুয়া, রুমি বড়ুয়া, অর্চনা বড়ুয়া ইলা, ইয়াসমিন শফী। অনেকের নাম বোধহয় বাদ পড়ে গেলো।
মনিরুল মনির তথ্য দিচ্ছেন, “স্বপন সেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।” আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স পড়ি (১৯৭৪–১৯৭৯) তখন ছাত্র ইউনিয়নের জেলা নেতা পুলক দত্ত, যার সাথে ছাত্র ইউনিয়নের কিংবদন্তি লিডার শেখর দস্তিদারের দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে টিলার বাসায় প্রায়ই দেখা হতো। ইউসুফ শিকদার চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম কলেজ শাখার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শেখর দস্তিদার, প্রয়াত মাহবুবুর রহমান এবং আমি একত্রে চট্টগ্রাম কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অ্যারেস্ট হয়ে জেল খেটেছি।
নব্বই দশকের সূচনালগ্নে, আমরা যখন চৌরঙ্গী সংস্কৃতি পরিবার গড়ে তুলি। তখনও স্বপন সেন চৌরঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেস্তোরাঁ, জেএমসেন হল, অধুনা (১৯৯০– এ পর্যন্ত) চেরাগি আড্ডায় পথ চলিতে দেখা হতো। তার প্রধান আলোচ্য বিষয়– রাজনীতি বিশেষ করে বামরাজনীতি, সাম্যের রাজনীতি।
স্বপন সেনের পরনে বিচিত্র রঙের পোশাক থাকতো। এমনকি গ্রীষ্মের সময়ও ব্লেজার পরিহিত স্বপন সেনকে নগরীর সড়কে দেখা গেছে। স্বপন সেন প্রায় তার বাবা রেলওয়ে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হৃদয় রঞ্জন সেনের কথা বলতো। বাবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মী ছিলেন বলে গর্ব করতো। তাছাড়া তার মেজো ভাই কেএন সেন পিডিবির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কথাও বলতো।
সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, প্রফেসর আসহাবউদ্দিন আহমেদ একবার রহমতগঞ্জস্থ অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র সিংহের বাসায় তাঁর গাত্রের শার্ট দেখে বলেছিলেন, ‘এটি আহসানিয়া মিশনের।’ (সচিব একেএম আহসান প্রদত্ত) ট্রাউজার হয়তো অন্য কোনো বড় আমলা বা মুদ্রাওয়ালা দিয়েছিলেন। স্বপন সেন আসহাবউদ্দিন সাহেবদের (পিকিংপন্থী) মিটিংয়েও যেতো। সে একবার আমার কাছে গল্প করেছিল বদরউদ্দিন উমর বা কেউ জেএমসেন হল– এ সভা করছেন। বক্তা ১৮ জন, শ্রোতা ১ জন। ওই শ্রোতাই হচ্ছে স্বপন সেন।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীপন্থী করলেও আমার সাথে মস্কোপন্থী চট্টগ্রাম ও কেন্দ্রীয় নেতা ও সংস্কৃতিজনদের সাথে বেশ ভালো সখ্যতা ছিল। আমার ভাই ও মিত্র কালাম চৌধুরী যেহেতু রাশিয়া ভ্রমণসহ মস্কোপন্থীদের সাথে পলিটিক্স করেছেন, আমাদের উনপঞ্চাশ ঘাটফরহাদবেগ– এর বাসায় অনেকে এসেছেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নুরুল আমিন (সোভিয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী ও শান্তি পরিষদ নেতা) তার গাড়িতে করে নিষিদ্ধ লিফলেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে আমাকে নিয়ে বহন করেছিলেন। সাবেক রেল প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। কোনো এক প্রথম রোজার রাতে সিরাজগঞ্জের আবুল কাশেম, কালাম চৌধুরী, পার্লামেন্টারিয়ন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ সেহরি পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছিলাম।
মোজাহের ঔষধালয় এর বিল্ডিংয়ে ন্যাপ নেতা নূরন্নবী সাহেব থাকতেন। নেতা যে পিতার মতো হতে পারে তার প্রমাণ– ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার নূরন্নবী। প্রতিরোধ সম্পাদক একেএম শহীদুল্লাহ্, সাহস–অধ্যয়ন–অনুশীলনের অপর নাম এলেমদার এডভোকেট এমদাদুল ইসলাম। চৌধুরী হারুনর রশীদ প্রায় প্যারালাইজড হয়ে এমপি ইলেকশন করেছেন। সদরঘাটস্থ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের বাসায় আহমদ ছফাসহ একটা আড্ডা হয়েছিল। রুমঘাটাস্থ ছাত্রলীগের নেতা প্রয়াত তারেক টুটুলসহ তৎকালীন কৃষক সমিতি নেতা অধ্যক্ষ ফজলুল হকের সাথে প্রায় দুদিন মিশেছিলাম। একটি ফার্মেসি উদ্বোধনের সময় আয়োজিত মিলাদে এক ইমাম সাহেবের মোনাজাতের গল্প করেছিলেন– ‘আল্লাহ এদের আয়–ইনকাম বাড়িয়ে দাও।’ প্রিন্সিপাল সাহেব তখন ইমামকে বললেন, এদের আয়–ইনকাম বাড়লে তো রোগ–শোক বেড়ে মহামারি লেগে যাবে। তাছাড়া মস্কোপন্থী অন্যান্য নেতা পুর্ণেন্দু দস্তিদার, কমরেড আবদুস সাত্তার, অনঙ্গ সেন, কক্সবাজারের কমরেড সুরেশ সেন, পুর্ণেন্দু কানুনগো, কমরেড মুসা, মাওলানা আহমদুর রহমান আজমী, এস এম হক, নগেন দে, অ্যাডভোকেট চিত্ত দাশ, অ্যাডভোকেট সি আর দাশ, আবদুল হাই, বখতিয়ার নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ, বালাগাতউল্লাহ, সাইফুদ্দিন খান, নূরজাহান খান, অশোক সাহা, উত্তম চৌধুরী, মৃণাল চৌধুরী, তপন দত্ত, অ্যাডভোকেট আবদুল মোমেন ভূঁইয়া, আলী আহমদ নাজির, কামাল আজিজুল হক, অধ্যাপক মাহবুবুল হক, মাহবুব মিন্টু, ইরফানুল হক সিদ্দিকী, মোয়াজ্জেম হোসেন, কানাই চক্রবর্তী, জসিম উদ্দিন চৌধুরী সবুজ, বাকশিস নেতা অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক রণজিত দে, নাজিমুদ্দিন শ্যামল, মহিলা সমিতির নেতা বেগম মুশতারী শফী, হান্নানা বেগম, ঝর্ণা বড়ুয়া ও আরো অনেকের নাম নেয়া যায়। এদের নাম উল্লেখ করলাম এজন্য যে স্বপন সেনের সাথে কথোপকথনে এইসব নামদের ওঠে আসতো। বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইশতেহার নেতা ও তাঁদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সে বেশ এলেম রাখতো।
আমি অনেক দিন ধরে এই সাধারণ মানুষ, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ভাষায়, ‘পান্থজনের সখা’ স্বপন সেনের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছি। কিন্তু তাকে বলাও হয়নি, নেওয়াও হয়নি। তিনি যখন জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন দেখতে যেতে চেয়েছিলাম। সেটাও হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ দিদারমার্কেটস্থ ঈশ্বর নন্দী লেনে তার বাসগৃহের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সে শায়িত তাকে দেখলাম। একা একজন। তথ্যমতে, বিএসসি ফেল করার পর থেকে স্বপন সেন খুব ডিসেপয়েন্টেড হয়ে যায়। কিন্তু তাদের এত বিত্তবৈভব থাকতেও সে কেন একটা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারল না! প্রায় অচিকিৎসিতভাবে তার মৃত্যু হয়। পাহাড়সম একটি প্রশ্ন স্বপন সেন রেখে গেল।
উৎপল দত্তের ভাষায়, ‘নির্মম নিয়তির মতো’ আমাদের সবাইকে চরম ঘৃণা জানিয়ে স্বপন সেন চলে গেল। সে ছিল মূলত আমাদের নিখিল রাজনীতি ও সংস্কৃতির চারণজন। একজন সাধারণ মানুষ কিন্তু জাতিস্বর হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতির ইতিহাসে।
তথ্যঋণ: ১। আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, মুজাফফর আহমদ, ২। আজিকে আকাশ তলে, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র–ছাত্রী কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন, ৩। কালাম চৌধুরী, ৪। মনিরুল মনির।
লেখক : নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক। পরিচালক, টিআইসি।












