চট্টগ্রামের মাটি বড়ই বিপ্লবী উর্বর। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হতে শুরু করে বাঙালির সকল স্বাধিকার আন্দোলনে চট্টগ্রাম নেতৃত্ব দিয়েছে। চট্টগ্রামের ব্রিটিশ আন্দোলনের ব্যাপ্তি দেখে মহাত্মা গান্ধী তাঁর ‘তরুণ ভারত’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় চট্টগ্রামকে অভিনন্দিত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম সবার আগে’, ‘চিটাগাং টু দি ফোর’। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহান যোদ্ধা ও সেনাপতি চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের প্রধান পুরোহিত মাস্টারদা সূর্যসেন। মাস্টারদার নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হতে শুরু করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামের যে কয়জন মহান যোদ্ধা ইতিহাসে আলোকিত করে রয়েছে তাদের অন্যতম হলেন বিপ্লবী ও রাজনীতিক অধ্যাপক পুলিন দে।
পটিয়ার বিপ্লবতীর্থ ধলঘাটে ১৯১৪ সালের ১ অক্টোবর বিপ্লবী অধ্যাপক পুলিন দে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সারদা কুমার দে, মায়ের নাম সাবিত্রী দেবী। তিন বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে পুলিন দে সবার বড়। বাবা ডাক কর্মচারী। ধলঘাটের স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়ার হাতেখড়ি। কৈশোরে কাকিমা তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন। পরবর্তীতে ধলঘাটের হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াবস্থায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদার সংস্পর্শে আসেন। ধলঘাট স্কুল হতেই কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন পুলিন দে। পরবর্তীতে মেধাবী ছাত্র বিপ্লবী পুলিন দে সকল পরীক্ষা জেলে বসেই দেন এবং কৃতকার্য হন। ১৯৩৫ সালে হিজলী জেল থেকে আই.এ, রংপুর জেল থেকে ১৯৩৭ সালে বি.এ এবং প্রেসিডেন্সী জেল থেকে ১৯৪৪ সালে এম.এ পাস করেন। সকল পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
স্কুল জীবনেই তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালতি ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মিতে যোগ দেন। সে সময় তাঁর নিকটতম বন্ধু দীনেশ দাশগুপ্ত, সুধাংশু বিশ্বাস, অজিত বিশ্বাস, নিত্যগোপাল চৌধুরী ও হৃদয় চৌধুরী প্রমুখ রিপাবলিকান আর্মিতে যোগদেন। ঐ সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি অংশ নেন। মাস্টারদার প্রিয়ভাজন হিসেবে তরুণ পুলিন দে বিপ্লবী সংগঠনের বার্তা বহন সহ জরুরি কর্মকাণ্ডে সম্পৃত্ত থেকে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। পুলিন দে নিজের ভাষায় বলেন, ‘পরে আরো অনেক তরুণ দলে যোগ দেয়। আমাদের গোষ্ঠীটি ছিল একটি শক্ত ও দৃঢ়চিত্ত নিবেদিত প্রাণ। তাই মাস্টারদা আমাদের অত্যধিক স্নেহ করতেন। আমরা নিজেদের বিশ্বাস, উপলব্ধি দেশপ্রেম ও দলের প্রতি আনুগত্য প্রদানের দৃঢ়সংকল্প ছিলাম’ (মুক্তিযুক্ত ও বাংলাদেশ ঃ পৃষ্ঠা-৪৭-৪৮)। পুলিন দে ম্যাটসিনি ও গ্যারিবণ্ডির জীবনী পড়ে। দেশ, মাটি ও মাকে ভালোবাসতে শেখেন। তবে গ্যারিবণ্ডির জীবনী তাঁকে দেশ প্রেমে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পুলিন দেকে ধলঘাটের নিজ বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৪২ সালে আবারও তাঁকে ভারত রক্ষা আইনে বন্দি করা হয়। প্রথমে তাকে ঢাকা জেলে পরবর্তীতে প্রেসিডেন্সী জেলে স্থানান্তর করা হয়। সে সময়ে পুলিন দের জন্য জেলখানা হয়ে উঠে লেনিনের ভাষায় “ইউনিভার্সিটি ফর দ্য পলিটিক্যাল ক্যাডার”। ১৯৪৫ সালে প্রেসিডেন্সী জেল হতে পুলিন দে মুক্তি পান। জেল হতে মুক্তি লাভের পর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট কলকাতার মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সমাজতন্ত্রী দলের রামমনোহর লোহিয়া কলকাতায় আসেন ১৭ আগস্ট জনসভা করার জন্য। মুসলিম লীগের কর্মীরা সমাজতন্ত্রী দলের সে সভা পণ্ড করে দেয় এবং ড. রামমনোহর লোহিয়া উপর আক্রামণ করা হয়। এতে তিনি আহত হন। ড. লোহিয়া সে সময় একটি ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে পুলিন দেকে দিল্লীতে কংগ্রেস নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিকট পাঠান। চিঠি পেয়ে বিস্তারিত জেনে নেহেরু রাগত স্বরে পুলিন দে কে বলেন, ‘ব্রিটিশ অস্ত্রাগার যারা লুট করতে পারে তারা মুসলিম লীগের গুণ্ডাকে দমন করতে পারে না’। পুলিন দে নম্র স্বরে উত্তর দেন ‘নিশ্চয় পারি কিন্তু কংগ্রেস সেটা সইতে পারবে?’ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সে সময় পুলিন দে কে শান্ত করে বলেন, ‘তুমি উত্তেজিত হয়ো না’।
১৯৪৭ এ ভারত ভাগ হয়ে দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হলে পুলিন দে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান এবং পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টি গঠন করেন। অল পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টির তিনি যুগ্নসম্পাদক এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে সাংগাঠনিক দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ১৯৫০ সালে ঢাকা সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনের সময় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে সংরক্ষিত আসনে মীরসরাই, ফেনী, নোয়াখালী আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। সে সময় তিনি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায়ও যোগদেন।
১৯৫৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশে সামরিক আইন জারি হলে পুলিন দেকে নিউহর্কের পরিবর্তে ধলঘাটে নিজগৃহে অন্তরীণ করে রাখা হয়। সে সময়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই ধলঘাট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরীতে যোগ দেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এক বছর পর মুক্তি দেয় হয়। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ৭০ এর নির্বাচনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ এর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মুক্তির সংগ্রাম শুরু হলে সোসালিস্ট পার্টি গড়ে তোলে ‘ইন্টারন্যাশনাল বিগ্রেড’। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টির বিশেষ ভূমিকা রাখে। সে সময়কালে ভারতের মাটিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বহিঃবিশ্বে প্রবাসী সরকারের পক্ষে কাজ করেন।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর তিনি মাতৃভূমিতে ফেরত আসেন এবং দেশগড়ার কাজে মনোযোগি হয়ে পড়েন। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী বাংলার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে ফেরত আসেন।
১৯৭২ এর ১২ জানুয়ারী পুলিন দে স্বাধীন বাংলাদেশের করণীয় বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিকট তিনটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। ১। পাকিস্তান থেকে আসা সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে ফেরত না নেয়া। ২। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ না করিয়ে বরং অস্ত্র সহ সেনাবাহিনীতে অন্তভর্ূুক্ত করে নেয়া। ৩। রাজাকার, আলবদর, আলশামস সহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীচক্রকে অন্তত পাঁচ বছর কঠোরভাবে দমন করিয়ে রাখা।
সে সময়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা অনেকে পুলিন দের প্রস্তাব সমর্থন করলেও খন্দকার মুশতাক সহ বঙ্গবন্ধুর অন্ধ ভক্ত বলে পরিচয়দানকারীরা অনেকে এক কথায় তা প্রত্যাখান করে। চিরকুমার পুলিন দে দেশের চলমান রাজনীতির অধগতি দেখে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি বলতেন, ‘আমরা রাজনীতি করেছি পকেটের পয়সা দিয়ে, ব্যাংকের টাকায় নয়’।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে তিনি জাতির এবং দলের প্রেরণাদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। অন্তর থেকে তিনি সমাজবাদী ও বিপ্লবী। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আমৃত্যু ধারণ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিরোধ স্পৃহায় শুধু একজন সাহসী যোদ্ধা নন, রাজপথের আন্দোলনে ছিলেন সর্বদা পুরোভাগে। আওয়ামী রাজনীতির ক্রান্তিকালে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময়ে তিনি একজন বড় মাপের নেতাই শুধু নন, কিংবদন্তী অগ্নিপুরুষের ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা তাঁর এই সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিপ্লবী আদর্শ দেখেছি জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনে দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনায়। তাঁর নেতৃত্বে মহিউদ্দিন চৌধুরী বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক এবং শেখ হাসিনার একজন ন্যায়নিষ্ঠ কর্মী অধ্যাপক পুলিন দে জয়নগরস্থ তাঁর বোনের বাসায় ১১ অক্টোবর ২০০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। অধ্যাপক পুলিন দে দেশ ও দলের জন্য সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। নির্লোভ, পরোপকারী দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক যোদ্ধা অধ্যাপক পুলিন দে ইতিহাসের এক বিস্মৃত অধ্যায়। বর্তমান সময়ের কলুষিত রাজনীতি ও রাজনীতিকদের মাঝে অধ্যাপক পুলিন দের রাজনৈতিক জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। মহান এ রাজনৈতিক নেতার জীবন প্রজন্মের রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য অন্যতম অনুসরণযোগ্য আদর্শ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক-শিল্পশৈলী