দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিবছর পাহাড়ের দুর্গম এলাকার মানুষেরা ঝিরি–ঝর্ণার পানির উপর নির্ভর করে তারা তাদের দৈনন্দিন পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে বিশেষ করে মার্চ–মে মাস পর্যন্ত প্রায় তিন মাস ঝিরি ঝর্ণা শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। এতে করে খাওয়ার পানি থেকে শুরু করে ব্যবহার্য পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয় পাহাড়ে। চলতি বছর দীর্ঘ অনাবৃষ্টির জন্য তাদের ভুগতে হচ্ছে আরও বেশি। জানা যায়, রাঙামাটির বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে বাঘাইছড়ি, সাজেক, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকলসহ কাপ্তাই উপজেলার বিভিন্ন দুর্গম এলাকার মানুষেরা এখন খাবার পানির সংকটে নিদারুণ কষ্টে রয়েছে। এ জায়গাগুলোতে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে খাওয়ার পানির জন্য ওইসব গ্রামবাসীকে দূর থেকে পায়ে হেঁটে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের নোয়াপাড়ার ফুলাচিং মারমা বলেন, ঝিরি–ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে আমরা খাবার পানির সংকটে ভুগছি। খাবার ও ব্যবহারের পানি অনেক দূরে গিয়ে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় ১ নম্বর বিলাইছড়ি ইউনিয়নে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দীঘলছড়ি মোন পাড়ায় সুউচ্চ পাহাড়ে ব্যবহার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকটে রয়েছে প্রায় ৪৫ পরিবার। এখানে বসবাস করে ২শ জনেরও অধিক মানুষ। পানির অভাবে গ্রামবাসীর অবস্থা খুবই করুণ। সেখানে রয়েছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও।
বিলাইছড়ির দীঘলছড়ি মোন পাড়ায় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হলে জানা গেছে, পাড়াটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উপরে যা বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ির সীমানার কাছাকাছি। পাহাড়ের ঢালে জুম চাষই তাদের একমাত্র পেশা। এই মোন পাড়ায় রয়েছে একটি মাত্র কূয়া। তাও পাহাড় বা পাড়া থেকে অনেক নিচে। সেখানে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে পানি সংগ্রহ করতে হয়। তাও বেশিরভাগ সময় পানি পাওয়া যায় না। বর্তমানে দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে সেটি একেবারে শুকিয়ে গেছে।
এসব বিষয়ে স্থানীয় দীঘল ছড়ি মোন পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কালিদাস চাকমা জানান, প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে তীব্র গরমে শুকিয়ে যায় কূয়ার পানি। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে জনজীবন। সবচেয়ে বেশি পানি সংকটে পড়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্যান্য শিশুরা।
বরকলের উপজেলার এরাবুনিয়া এলাকার গৃহিণী আছিয়া বেগম বলেন, লেকের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আমাদের পানি পেতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বরকল উপজেলা সদরের বাসিন্দা অনুকা দেবী চাকমা বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য খুবই কষ্ট হয়। পাহাড়ের ঝর্ণা থেকে যে পানি পাওয়া যায় তা দিয়ে কোনোরকমে চলতে হয়। তিনি বলেন, এক কলসী পানি নেয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপক্ষো করতে হয়।
বরকলের আইমাছড়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ার্যম্যান সুবিমল দেওয়ান বলেন, বরকল উপজেলায় পানির যে সংকট তা থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। তিনি বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে আমরা আগে যে ঝিরি ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে খেতাম তাও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। কর্ণফুলী নদী থেকে পাইপ দিয়ে পানি তুলে ফুটিয়ে কোনোমতে খেতে হচ্ছে।
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলাধীন চেলাছড়া গ্রামের বাসিন্দা রেখিন চাকমা বলেন, পানির অভাবে আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। ৮–১০ ফুট কুয়া খুঁড়েও অনেক সময় একফোটাও পানি পাই না। ভাগ্যে থাকলে হয়তো একটু পানি পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, পাহাড়ি এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক কারণে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এবং মানুষের প্রতিদিনের পানির যে চাহিদা তা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানির কিছুটা সংকট হচ্ছে। তিনি বলেন, পাহাড়ি এলাকায় বিছিন্নভাবে যে গ্রামগুলো আছে সেগুলো পানির সরবরাহের আওতায় আনতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলার প্রতি উপজেলায় ১৮টি করে মোট ১৮০টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। আগামী জুন মাসের মধ্যে এর কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, রাঙামাটির সাজেকেও পানির সমস্য দূরীকরণের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি পরিশোধানাগার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।