গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, ‘রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থী হতে হলে সংশ্লিষ্ট দলের প্রত্যয়নপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে’। এ নিয়ম রক্ষার জন্য ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের দল মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে বিএনপি। তবে চট্টগ্রাম–৬ (রাউজান) আসনে এ প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয় দলের দুই নেতাকে। ফলে সংসদীয় আসনটির ভোটার ও বিএনপি সমর্থকদের প্রশ্ন, রাউজানে বিএনপির প্রার্থী কে? এ বিষয়ে দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, চূড়ান্ত প্রার্থীর জন্য আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।
জানা গেছে, গতকাল বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকারকে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। এতে তারিখ রয়েছে ২৭ ডিসেম্বর। এর আগে ৪ ডিসেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস কাদের চৌধুরীকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৩ ডিসেম্বর গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দল থেকে প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। এতে তারিখ ছিল ২০ ডিসেম্বর। গিয়াস কাদের ও গোলাম আকবর দু্জনেই আজাদীর কাছে দাবি করেছেন তারা বিএনপির প্রার্থী। তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, আপাতত কৌশলগত কারণে দুজনই দলের প্রার্থী হিসেবে থাকছেন। প্রতীক বরাদ্দের আগে দুজনের একজনকে চূড়ান্ত করা হবে; যা নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি তাদেরকেও জানিয়ে দেয়া হবে।
এদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দলীয় প্রার্থী প্রত্যয়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থী হতে হলে সংশ্লিষ্ট দলের প্রত্যয়নপত্র মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। এক আসনে এক দলের একাধিক প্রার্থী থাকতে পারে, বাছাইয়ে বৈধ হলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগেই একজনকে চূড়ান্ত করতে হবে সংশ্লিষ্ট দলকে’।
এ বিষয়ে বিএনপির সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগ) ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল আজাদীকে বলেন, রাউজানে গোলাম আকবর খোন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের দুজনকে দল মনোনয়ন দিয়েছে। দল চাইলে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র দিতে পারে। অনেক সময় বিকল্প হিসেবে এ ধরনের মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়। যেহেতু এখনো সময় আছে, তাই শেষ মুহূর্তে দল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে একজনকে প্রার্থী রাখবে।
গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী আজাদীকে বলেন, দল প্রার্থী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করেছে, আমি টাকা জমা দিয়েছি। এরপর মনোনয়নের চিঠি পেয়েছি। আমি যথারীতি ইলেকশন কমিশন থেকে মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছি। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল (সোমবার) রাউজানে সেটা আমি জমা দেব। আমি নির্বাচনের মাঠে ছেড়ে যাব না।
গোলাম আকবর খোন্দকার আজাদীকে বলেন, দল শেষ মুহূর্তে আমার প্রতি আস্থা রেখেছে, তাই আমি দলের প্রতি কৃতজ্ঞ। এই মনোনয়নের মাধ্যমে রাউজানের আপামর জনসাধারণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও দখলদারমুক্ত রাউজান গড়তে কাজ করতে চাই। জনগণ যদি আমার উপর তাদের আস্থা রাখে আমি অবশ্যই উন্নয়নের মাধ্যমে এর প্রতিদান দেব ইনশাআল্লাহ।
এর আগে দল থেকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, আমাকে দেয়া হয়েছে ২৭ ডিসেম্বর। উনাকে দেয়া হয়েছে ২০ ডিসেম্বর। আমারটা লেটেস্ট।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে রাউজানে কোণঠাসা ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। শীর্ষ নেতারা ছিলেন এলাকাছাড়া। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে রাউজানে সক্রিয় হয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। তবে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন তারা। এদের এক গ্রুপ গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং অপর গ্রুপ গোলাম আকবর খোন্দকারের অনুসারী। বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষেও জড়ান তারা। ৫ আগস্টের পর থেকে রাউজানে ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের দাবি, দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণেই সংঘটিত হয়েছে এসব হত্যাকাণ্ড।
জানা গেছে, গত জুলাই মাসে রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গোলাম আকবর খোন্দকারসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী ও পথচারী আহত হয়েছেন। এ সময় কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনার জের ধরে উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত এবং গিয়াস কাদেরের দলীয় পদ স্থগিত করা হয়।
দুই প্রার্থী সম্পর্কে : গিয়াস উদ্দীন কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। গত ২৯ জুলাই পদটি স্থগিত করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন গিয়াস উদ্দীন কাদের চৌধুরী। এরপর অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিএনপির প্রার্থী হলেও পরাজিত হন।
রাউজান উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদ আজাদীকে বলেন, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গত ৪ ডিসেম্বর দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। তাকে দল থেকে মনোনয়ন দিয়ে চিঠিও দেয়া হয়। এর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের অফিসিয়ালি জানায়নি। সুতরাং রাউজানে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীই দলের প্রার্থী। এর বাইরে অন্য কিছুতে বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ নেই। রাউজানে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী কোনো বিকল্প নেই। ৯৬ সালে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। মাঠের নেতাকর্মীরা তার সাথে আছেন। গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থাকবেন। রাউজানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারলে তিনি বিজয়ী হবেন।
গোলাম আকবর খোন্দকার ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে সদস্য নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ আহ্বায়ক কমিটি গত ২৯ জুলাই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর আগে তিনি ১৯৮৪ ও ১৯৯২ সালে উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৯৫ ও ২০০৩ সালে সভাপতি ছিলেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদকও ছিলেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাউজান উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, গোলাম আকবর খোন্দকার একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি রাজনীতি করেন। রাউজানের মানুষের কাছেও তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। দলের হাই কমান্ড তাকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে শত্রু–মিত্র সবাইকে নিয়ে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিতে কাজ করব। তিনি নির্বাচিত হলে সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ রাউজান গড়ে তুলবেন।
আসন সম্পর্কিত : ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রথম থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্যে রাউজানে আওয়ামী লীগ ৬ বার, বিএনপি ৩ বার, জাতীয় পার্টি ২ বার ও এনডিপির প্রার্থী একবার বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্যে রাউজানে প্রথম (১৯৭৩) নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন বাংলাদেশ সংবিধান রচয়িতা কমিটির অন্যতম সদস্য দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। দ্বিতীয় (১৯৭৯) সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে জহির উদ্দিন খান, তৃতীয় (১৯৮৬) সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে (১৯৮৮) জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) এনডিপি থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) বিএনপি থেকে গোলাম আকবর খোন্দকার ও সপ্তম (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী নির্বাচিত হন।
২০০১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পাঁচটি নির্বাচনে অর্থাৎ অষ্টম থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। এর মধ্যে অষ্টম (২০০১) ও নবম (২০০৮) সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন জসীম উদ্দিন শিকদার। ২০১৪ সালের দশম ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি।












