রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের বিএনপি কর্মী ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমের খুনের সাথে জড়িতদের স্বীকারোক্তিমতে নোয়াপাড়ায় পুলিশের অভিযানে থানা থেকে লুণ্ঠিত চাইনিজ রাইফেলসহ বিপুল সংখ্যক অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। গত রোববার গভীর রাত থেকে দক্ষিণ রাউজানের সন্ত্রাসপ্রবণ এলাকা নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরীহাটের পাশে থাকা আইয়ুব আলী সওদাগরের বাড়িতে পুলিশের এই অভিযান চলে। গতকাল সোমবার দুপুরে অভিযান শেষ হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, রাতে বাড়ি ঘেরাও করে পরিচালিত অভিযানে সাবেক ইউপি সদস্য প্রয়াত বজল আহমদের ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় চারটি বিদেশি পিস্তল ও রিভলবার, ৪২ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ১৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, শটগানের ১৬ রাউন্ড কার্তুজ, সাতটি খালি ম্যাগজিন, একটি রকেট ফ্লেয়ার, দুটি রামদা এবং ৫০ পিস ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা। সন্ত্রাসীদের এই আস্তানায় পাওয়া যায় নগদ ৯৬ হাজার টাকা। এ সময় ওই বাড়ির মুহাম্মদ শওকতের ছেলে মো. সাকিব (২০) ও মুহাম্মদ সোবহানের ছেলে মো. শাহেদকে (২৫) আটক করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, হাকিম হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে অভিযানের ধারাবাহিকতায় আটক সন্ত্রাসীদের স্বীকারোক্তি নিয়ে সর্বশেষ অভিযানটি পরিচালিত হয় চৌধুরীহাট এলাকায়। রোববার রাত থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত পরিচালিত এই অভিযানে বাড়ির পেছনে থাকা একটি পুকুরের অস্ত্র ফেলে দেয়ার তথ্য পেয়ে পুকুরের পানি সেচতে লাগানো হয় বড় পাম্প। সেচ দেয়ার পর প্লাস্টিকের বস্তা মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয় থানা থেকে লুণ্ঠিত একটি চাইনিজ রাইফেলসহ একটি শটগান। পুকুর থেকে উদ্ধার করা অস্ত্রে গুলি লোড করা ছিল।
টার্গেট কিলিংয়ে যুক্ত ছয়টি গ্রুপ : বিডিনিউজ জানায়, রাউজান উপজেলায় বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ বলছে, সেখানে ছয়টি গ্রুপ টার্গেট কিলিংয়ের মতো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যাদের একটি গ্রুপ এক মাস আগে রাস্তায় গাড়ি আটকে ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে হত্যা করে।
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, তদন্তে নেমে পুলিশ চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য ও ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকের নাম পেয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে সেসব এখনই প্রকাশ করছেন না তারা। ছয়টি গ্রুপের পাশাপাশি আরো দুয়েকটি গ্রুপও টার্গেট কিলিংয়ে যুক্ত বলে তিনি জানান।
৭ অক্টোবর সন্ধ্যার কিছু আগে হাটহাজারীর মদুনাঘাট ব্রিজের কাছে একদল লোক প্রাইভেটকার আটকে রাউজানের ব্যবসায়ী আবদুল হাকিমকে গুলি করে হত্যা করে। হাকিম রাউজানের হামিম অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক। এ ঘটনায় পুলিশ রাউজানের নোয়াপাড়া চৌধুরীহাট এলাকায় রোববার রাত থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে দেশি–বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র ও গুলি করেছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে রাউজান থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলিও রয়েছে।
আবদুল হাকিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তে নেমে অস্ত্র উদ্ধারের পর গতকাল বিকালে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেখানে পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু এক বছরে রাউজানে সংগঠিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও জড়িত চক্রগুলোর ব্যাপারে কথা বলেন।
পুলিশ সুপার বলেন, উদ্ধার করা চাইনিজ রাইফেল ও ৪৯ রাউন্ড গুলি গত বছরের ৫ আগস্টে রাউজান থানা থেকে লুট হয়েছিল। আর শটগানটির হাতলটি একনলা বন্দুকের হাতলের মতো। সেটি তারা পরিবর্তন করেছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আবদুল হাকিম হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারদের বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, ৩১ অক্টোবর রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের গরিব উল্লাহ পাড়া থেকে আব্দুল্লাহ খোকন ওরফে ল্যাংড়া খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ব্যবসায়ী হাকিম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। তার দেওয়া তথ্যে ২ নভেম্বর রাউজানের নোয়াপাড়া থেকে হত্যাকাণ্ডের জড়িত থাকার অভিযোগে মারুফ নামে অপর একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মারুফ জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রের বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। অস্ত্রটি সাকলায়েন নামে একজনের কাছে রয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন তিনি। রিমান্ডে সাকলায়েন ও মারুফের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে রোববার রাতে নোয়াপাড়ার চৌধুরীহাট আইয়ুব আলী সওদাগর বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।
আবদুল হাকিম হত্যাকাণ্ডে ১৫ জন : পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ১৫ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি কিলিং মিশনে, একজন মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ি অনুসরণ করেন এবং মদুনাঘাট ব্রিজের অন্য প্রান্তে অবস্থান নিয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেন। গতকাল উদ্ধার করা অস্ত্র হাকিম হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয় বলে মন্তব্য করেন পুলিশ সুপার। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়াদের বেশিরভাগ রাউজানের ও অন্যরা হাটহাজারীর বাসিন্দা বলে জানান তিনি।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ৩১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর রোববার রাতে নোয়াপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় দুজনকে।
সরোয়ার হত্যার আসামিরা জড়িত অন্য হত্যাকাণ্ডেও : ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর চালিতাতলী এলাকায় বিএনপি প্রার্থীর জনংযোগে গুলি করে সরোয়ার হোসেন বাবলাকে হত্যার মামলার আসামি রায়হান ও ইমন ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিল বলে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, সরোয়ার হত্যা মামলায় যে গ্রুপটির নাম আসছে, আমাদের তদন্তে আবদুল হাকিম হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে রাউজানে সংগঠিত অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক কারণে আলোচনায় রয়েছে রাউজান উপজেলা। এ উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর বিলুপ্ত করা হয় চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি এবং দলটির কেন্দ্রীয় নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদ স্থগিত করা হয়। এক বছরে রাউজানে অন্তত ১৭টি খুনের খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, রাউজানে যেসব হত্যাকাণ্ডের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে সাতটি আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হয়েছে। অন্য হত্যাকাণ্ডগুলো পারিবারিক, পরকীয়া, মাদকের কারণে হয়েছে।









