গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর থেকে রাউজানে শুরু হওয়া সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব বন্ধ হচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই গোলাগুলির শব্দে মানুষের রাতের ঘুম হারাম হয়ে আছে। নোয়াপাড়া, পূর্ব গুজরা, বাগোয়ান, কদলপুর এলাকার জনসাধারণ বলেছেন, সন্ধ্যার পর গ্রামীণ রাস্তায় চলাচলে ভয় পাচ্ছে মানুষ। দল উপদলে বিভক্ত সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি করে থাকায় স্ব স্ব এলাকায় প্রতিপক্ষকে পাহারা দিতে সশস্ত্র অবস্থায় মহড়ায় থাকে। এমন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় প্রতিদিন পরস্পরের বিরুদ্ধে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন।
চলমান এমন পরিস্থিতির সর্বশেষ ঘটনায় মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা গতকাল ২৪ জানুয়ারি নোয়াপাড়ায় নিরপরাধ এক ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমকে গুলি করে হত্যা করেছে। এই ঘটনায় আরো দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে রাউজানের পরিস্থিতিকে এলাকার মানুষ বিস্ফোরণমুখর বলে বর্ণনা করেছে। অনেকে আরো বড় ধরনের সংঘাতের আশংকা করছে।
স্থানীয় জনসাধারণের অভিযোগ, এই উপজেলায় দ্বিধা বিভক্ত বিএনপির আধিপত্য বিস্তারের খেলায় পাঁচ আগস্ট থেকে অরাজক পরিস্থিতি চলছে। উপজেলার সর্বত্র এখন ত্রাসের রাজত্ব চলমান রয়েছে।
এলাকার জনসাধারণ সূত্রে জানা যায়, স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে এই পর্যন্ত এই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত অর্ধ শতবার সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এসব ঘটনায় গুলিবিদ্ধসহ এই পর্যন্ত আহত হয়েছে শ’খানেক লোক। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগ নিরহ পথচারীরা। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণও করেছে।
সূত্র মতে, রাউজানে বেশি ঘটনা ঘটছে পাহাড় ও কৃষিজমি থেকে মাটি কেটে ভরাট কাজের ব্যবসা নিয়ে। আছে চাঁদাবাজির এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়েও। অভিযোগ রয়েছে এসব কাজে যারা জড়িত তারা সগৌরবে পরিচয় দিচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মী বলে।
জানা যায়, এমন পরিচয়ধারীদের কেউ কেউ মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চলমান উন্নয়ন কাজে বাধা দিচ্ছে। এরকম অভিযোগ উঠেছে উপজেলার পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের মগদাই খালের উপর ব্রিজ নির্মাণ কাজেরও।
স্থানীয় জনসাধারণ জানিয়েছে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে দেড় কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এমন অবস্থার মধ্যে গত প্রায় এক মাস আগে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি কাজ ফেলে চলে গেছে।
কদলপুর ইউনিয়নের জনসাধারণ সূত্রে জানা যায়, সেখানে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে বেড়ায়। রাতে গুলি গোলার শব্দে এলাকার মানুষ ঘুমাতে পারে না। ওই এলাকায় পাহাড় কাটার মাটি বিক্রি নিয়ে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। গত দুই মাসে একাধিকবার পক্ষ–বিপক্ষে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কয়েকজন গুলিবিদ্ধও হয়েছে। জানা যায়, কদলপুরের সোমবাইজ্যাহাট ও নতোয়ানবাগিচা এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে থাকেন সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেখে। গত কয়েকদিন আগে নোয়াজিশপুর ফতেহনগর এলাকায় বিএনপির এক গ্রুপ প্রতিপক্ষ গ্রুপের এক কর্মীকে গুলি করে। এমন সংঘর্ষ সংঘাতের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে উপজেলার হলদিয়া, ডাবুয়া, বিনাজুরী, নোয়াপাড়া, বাগোয়ান, পাহাড়তলী, পূর্বগুজরাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে। বিএনপি আদর্শিক রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন রাউজানে চলমান ঘটনায় রাউজানের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। স্বৈরাচারের পতনের পর এমন অরাজক পরিবেশ কেউ আশা করেনি। কেউ কেউ বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপর ১৭ বছর নির্বাসনে থাকা বিএনপির নেতাকর্মীরা এলাকায় এসে দুই নেতার রাজনীতির বিভক্তির সুযোগ নিয়ে চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়তে দল উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারা চাঁদাবাজির পাশাপাশি বালু ও মাটির ব্যবসায় জড়িয়ে প্রতিটি এলাকায় অরাজক পরিস্থিতি করে রেখেছে। এসব ঘটনায় আতংকিত অনেক পরিবার ছেলে মেয়েকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে ব্যবসা–বাণিজ্য করতে পারছেন না।
জানা যায়, চলমান এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে স্থানীয় দুই সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকার ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিভিন্ন সভাসমাবেশে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বার বার সাবধান বাণী উচ্চারণ করে আসছেন। দুই নেতাই দাবি করছেন যারা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস সংঘর্ষে লিপ্ত তাদের সাথে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নাই। চলমান অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে রাউজান থানার ওসির সাথে কথা বললে তিনি জানান, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেখানে ঘটছে সেখানে পুলিশ যাচ্ছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে এলাকার মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে যায় না। বেশির ভাগ ঘটনায় বিএনপির দুই বিভক্ত গ্রুপ জড়িত বলে তিনি স্বীকার করেন।