বরফে ঢাকা থাকে সারাবছর, যে অঞ্চল কেউ দখলের আগ্রহ প্রকাশ করে না–সে অঞ্চলটি হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকা। দখলের আগ্রহ না থাকলেও আবিষ্কারের আগ্রহের কমতি নেই। তবে বিংশ শতাব্দী থেকেই সেই রহস্য উদ্ঘাটনের মহাযজ্ঞে রাতদিন এক করেছেন গবেষকরা। সমপ্রতি ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের বিজ্ঞানীরা অ্যান্টার্কটিকার বিস্তৃত বরফের আড়ালে লুকানো ভূদৃশ্যের সবচেয়ে বিস্তারিত মানচিত্র তুলে ধরেছেন। বরফের এই মহাদেশের উচ্চতা, বরফের ঘনত্ব এবং হিমবাহের উপ–ভৌগোলিক অবস্থানের তথ্য সমৃদ্ধ বেডম্যাপ ৩ উপস্থাপন করেছেন বিজ্ঞানীরা। ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিকার সার্ভের এই অভিযানে অংশ নিয়েছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমান ডেটার পাশাপাশি ৬০ বছরের পুরনো ডেটাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। যার ফলস্বরূপ বেডম্যাপ ৩ এর মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকার একাধিক না জানা তথ্য জনসমক্ষে।
সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকায় বরফের নিচে ৩৩২টি নতুন গিরিখাতের সন্ধান পেয়েছেন স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব বার্সেলোনা এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কের একদল গবেষক। এতদিন এসব গিরিখাতের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা ছিল না। গবেষকরা দাবি করছেন যে, নতুন আবিষ্কৃত গিরিখাতগুলোর মধ্যে কিছু গিরিখাত ৪ হাজার মিটার পর্যন্ত গভীর, যা যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতার সমান। গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন আবিষ্কৃত গিরিখাতগুলো অ্যান্টার্কটিকার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বহন করছে। পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার গিরিখাতগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত এবং শাখা–প্রশাখাযুক্ত। সেখানকার বরফের স্তর দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল রয়েছে। অন্যদিকে, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার গিরিখাতগুলো বেশ খাড়া ও সরল এবং আকারেও বেশ ছোট। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই গিরিখাতগুলো সমুদ্রের পানিপ্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রের ঘন ও লবণাক্ত পানি এসব গিরিখাত দিয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়, আর তাই বৈশ্বিক সমুদ্র স্রোত পরিচালনায় এই গিরিখাতগুলোর ভূমিকা রয়েছে। তাদের ধারণা, গভীর সমুদ্রের উষ্ণ পানি এই গিরিখাতগুলোর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কিছু বরফের স্তরকে দ্রুত গলিয়ে দিচ্ছে।
নাসার স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি অনুযায়ী, অ্যান্টার্কটিকার বরফের স্তর দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে এই মহাদেশের বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে অ্যান্টার্কটিকার পশ্চিম অংশের বরফের স্তর প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমছে। বিশেষ করে আমুন্ডসেন সমুদ্র এলাকায় বরফ খুব দ্রুত গলছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে ঠাণ্ডা জলবায়ু অঞ্চল –একটি অনুর্বর ভূমি যেখানে খুব কম জীবই বেঁচে থাকতে পারে। দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত দুটি মহাদেশের মধ্যে একটি, অ্যান্টার্কটিকাকে বোঝা তুলনামূলকভাবে সহজ একটি মহাদেশ বলে মনে হতে পারে। এটি দক্ষিণ মহাসাগরে অবস্থিত একটি বিশাল বরফের চাদর যেখানে জীববৈচিত্র্য খুব কম। কিন্তু এই হিমশীতল ভূদৃশ্য আসলে আপনি যা ভাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ।
এটি বিশ্বের বৃহত্তম বরফের ভর, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ছোট এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রায় দ্বিগুণ আকারের। বরফটি প্রায় ৭,০০০ ফুট পুরু এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ভূমিকা পালন করে, সূর্যের তাপ প্রতিফলিত করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাইক্রোস্কোপিক উদ্ভিদ এবং প্রস্ফুটিত শৈবাল, শ্যাওলা, লাইকেন এবং ঘাসের আবাসস্থল, যা প্রতি বছর শত শত টন কার্বন শোষণ করে। অ্যান্টার্কটিকার বরফের স্তর বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং সমুদ্র স্রোত নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা কারণে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে শুরু করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে পৃথিবীর অনেক অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে আরো জাগিয়ে তুলেছে। অ্যান্টার্টিকার গিরিখাত দ্রুত বরফ গলিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ঘন ও লবণাক্ত পানি এসব গিরিখাত দিয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হওয়ায় সমুদ্রের স্রোত ও গতিধারারও পরিবর্তন হতে পারে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।










