মহান রাব্বুল আ’লামিন তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য কিছু গুণাবলী নির্ধারিত করেছেন, যা তাদেরকে পরকালীন জীবনে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারেন। যে গুণাবলীর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা মুমিনদেরকে জান্নাতে এমন একটি এপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছেন যা ১০টি পৃথিবীর সমান। এই জান্নাত পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মুমিনদেরকে অধিকতর তৎপর হয়ে নিজের জীবনকে সমস্ত অনৈতিক কামনা–বাসনা থেকে যোজন যোজন দূরে রাখতে হবে। নিজের নফসকে সমস্ত পাপ–পঙ্কিল পরিবেশ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আল্লাহ তাঁর পবিত্র কালামে পাকে রহমানের বান্দাদের কিছু গুণাবলী নির্ধারিত করেছেন, যেমন: সূরা ফোরকানের ৬৩ থেকে ৬৫ নং আয়াত পর্যন্ত ৪টি গুণাবলী রয়েছে, এগুলো নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। মহান রাব্বুল আ’লামিন বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহতায়ালার বান্দা তো হচ্ছে তারা, যারা জমিনে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যক্তিরা অশালীন ভাষায় তাদের সম্বোধন করে–তখন তারা নেহায়েৎ প্রশান্তভাবে জবাব দেয়, যারা তাদের মালিকের উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে, দন্ডায়মান থেকে তাদের রাতগুলো কাটিয়ে দেয়। যারা বলে, হে আমাদের মালিক, তুমি আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাব দূরে রাখ, কেননা তার আযাব হচ্ছে নিশ্চিত বিনাশ’। এই ৩টি আয়াতের মাধ্যমে মুমিনের ৪টি গুণ পরিলক্ষিত হয়েছে। সূরা ফোরকানের প্রথম আয়াত, ‘কত মহান তিনি যিনি তাঁর বান্দার উপর (সত্য–মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী) ফোরকান নাযিল করেছেন’– এই আয়াত থেকে এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এটি একটি মাক্কী সূরা অর্থ্যাৎ রাসূল (সাঃ) এর হিযরতের পূর্বে নাযিল হয়েছে। এটির আয়াত সংখ্যা ৭৭, রুকু ৬টি। আলোচ্য বিষয়ের আলোকে প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে–মুমিন বান্দারা পৃথিবীর জমিনে অত্যন্ত বিনয় ও নম্রতার সহিত চলাফেরা করে। তারা অহংকার, ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, ঝগড়া–ফাসাদ, জুলুম–অত্যাচার করে না। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে–হযরত লোকমান (আঃ) যিনি কোন নবী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি। তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা তাঁর মনিবকে পর্যন্ত অবাক করে দিয়েছিল। হযরত লোকমান (আঃ) তাঁর প্রিয় পুত্রকে নসিহত করতে গিয়ে বললেন, ‘হে বৎস–তুমি কখনো অহংকারবশে তোমার গাল ফুলিয়ে মানুষদেরকে অবজ্ঞা কর না এবং আল্লাহর জমিনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচারণ কর না। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা ঔদ্ধত্যপূর্ণ অহংকারীদেরকে পছন্দ করেন না’– সূরা লোকমান – ১৮। কৃত্রিমভাবে কোমর বাঁকিয়ে, মাথা ঝুঁকিয়ে, রুগ্ন ব্যক্তির মত পায়ে পায়ে চলা এখানে উদ্দেশ্য হতে পারে না। হযরত ওমর (রাঃ) জনৈক যুবককে খুব ধীরে চলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন। তুমি কি অসুস্থ? সে বলল– না। তিনি তাঁর প্রতি চাবুক উঠালেন এবং শক্তি সহকারে চলার আদেশ দিলেন। রাসূল (সাঃ) নিজে ধীর পদক্ষেপে চলাচল করতেন। এই আয়াতের মূল আকর্ষণ হচ্ছে: মুমিন বান্দাদের চলাফেরা হতে হবে অত্যন্ত স্থিরতার সাথে, গাম্ভির্যতা ও বিনয় সহকারে। যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে, তারা কখনো অহংকারী হয় না। অত্যাচারী, স্বৈরাচারী ও বিপর্যয়সৃষ্টিকারী লোকদের মত দাপট দেখায় না। রাসূল (সাঃ) এমনভাবে চলতেন যে, মনে হত তিনি কোন উঁচু জায়গা থেকে নিচে নামছেন–জমিনকে যেন তাঁর জন্য জড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যখন তোমরা সালাতের জন্য আস, তখন দৌঁড়ে আস না, বরং শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে আস। জামাতের সাথে যা পাবে তা আদায় করে নাও এবং যা ছুটে যাবে তা পুরো করে নাও’। একজন নির্লজ্জ ব্যক্তির চালচলন, একজন গুন্ডা ব্যক্তির চালচলন, একজন অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির চালচলন, একজন দাম্ভিক ব্যক্তির চালচলন, একজন মর্যাদাবান ব্যক্তির চালচলন, একজন গরীব মিসকিন ব্যক্তির চালচলন দেখে নিমিষেই বুঝা যায় এই চালচলনের মাঝে কোন্ ধরনের ব্যক্তি চরিত্র সুস্পষ্ট হয়েছে। রহমানের বান্দাদের চালচলন দেখে বুঝা যায়–এরা কি ধরনের লোক। একজন সাধারণ মানুষ তা দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই জানতে পারে যে, এরা অত্যন্ত ভদ্র, সহিষ্ণু ও সহানুভূতিশীল লোক। পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুমিনের গুণাবলী এভাবেই বর্ণনা করেছেন, মূর্খ লোকেরা যখন তাদের সাথে মূর্খতাসম্পন্ন কথা বলে তখন তারা উল্টো গালমন্দ না করে প্রশান্তভাবে সেটার জবাব দেয়। তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়। কখনো মন্দ আচরণ করে না। রাসূল (সাঃ) এর চরিত্র ছিল এই যে, কোন লোক যখন তাঁকে কড়া কথা বলত, তিনি ততই নরম কথা বলতেন। রহমানের বান্দাদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল: তারা বাজে কথাবার্তার জবাবে কোন বাজে কথা বলে বেড়ায় না। অন্যায় দোষারোপের জবাবে অন্যায় দোষারোপ করে না। বরং এরূপ যারা আচরণ করে তাদেরকে তারা সালাম দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। এই ব্যাপারে আল কোরআনের অন্যত্র একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যখন তারা কোন বাজে কথাবার্তা শুনতে পায়, তখন তারা তা উপেক্ষা করে চলে এবং বলে, ভাই আমাদের কাজ আমাদের জন্য আর তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য। তোমাদের প্রতি সালাম, জাহেলদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই’– সূরা কাসাস– ৫৫। এর পরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা অন্যতম গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন, ‘তারা রাত্রি অতিবাহিত করে তাদের রবের উদ্দেশ্যে সেজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে। তারা বিছানা হতে পৃথক হয়ে যায়। তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় বিদ্যমান থাকে’। সূরা যারিয়াতের ১৭ ও ১৮ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে বলছেন, ‘তারা রাতের সামান্য অংশই অতিবাহিত করত নিদ্রায়, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত’। সূরা আস্–সাজদার ১৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে’। এই আয়াতের প্রেক্ষিতে বলা যায়: জাহিলিয়াতের যুগে মানুষ রাতের বেলায় আমোদ–ফূর্তি ও নিজস্ব লালসা চরিতার্থ করে, নাচ গানের তামাশা করে কিংবা চুরি–ডাকাতি করে তাদের রাতগুলো অতিবাহিত করত। এদের মধ্যে রাসূল (সাঃ) এর দাওয়াত পেয়ে ইসলামের সু–মহান আদর্শের ছায়াতলে সমবেত হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যান। এ সকল আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দিনের বেলা শিক্ষা দান, ইসলামের প্রচার ও জিহাদে লিপ্ত থাকত। অপরদিকে রাত্রিবেলায় আল্লাহর দরবারে দন্ডায়মান অবস্থায়, বসা অবস্থায় ও শয়ন অবস্থায় ইবাদত বন্দেগী করে রাত অতিবাহিত করতেন। তাদের পরিচ্ছন্ন জীবনের এই দিনগুলো আল্লাহতায়ালা তাঁর পবিত্র কালামে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, ‘তাদের পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশ সুখ শয্যা থেকে আলাদা হয়ে যায়, তারা তাদের রবের প্রতি ভয় ও আশা পোষণ করে, তাদের রবকে ডাকতে থাকে’– সূরা আস–সাজদা – ১৬। অন্যত্র এক আয়াতে বলেন, ‘এই জান্নাতী লোকেরা ছিল তারাই, যারা রাতের বেলায় খুব কমই ঘুমায়। এরা ভোর রাতে মাগফেরাতের দোয়া করতে থাকে’– সূরা যারিয়াত ১৭–১৮। এরপরের আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক–আমাদেরকে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাচাঁও। কেননা এর শাস্তি তো নিশ্চিত বিনাশ’। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যায়, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দিন রাত আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা সত্ত্বেও এভাবে অহংকার করে না যে, তাদের ইবাদতের বদৌলতে তারা জান্নাতে দাখিল হয়ে যাবে বরং তারা তাদের নেক আমল বৃদ্ধি করতে থাকে ও আল্লাহকে ভয় করে ও আল্লাহর কাছে তাদের অক্ষমতাকে তুলে ধরে প্রার্থনা করতে থাকে যে, হে আল্লাহ! আমাদের ভুল–ভ্রান্তি ও দোষত্রুটি ক্ষমা করে দাও এবং আমাদের থেকে জাহান্নামের আযাবকে হটিয়ে দাও। তোমার অনুগ্রহ ও দয়ার উপরে আমরা নির্ভরশীল। তোমার দয়া ছাড়া আমাদের কোন ইবাদত আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারবে না। এই গুণাবলী অর্জন করার জন্য আমাদেরকে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। তবেই আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য মেহনত করতে হবে প্রতিটি মূহুর্তে, নিজের হায়াত অবধি ।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল