ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনতাম–
‘লালুর জামাই আইয়ের দে/ লাল কুরা অ জোরাইদে/ জামাই আইলে ডেইঙ্গা রাতা / বিয়াই আইলে রসের কথা।’
মেজ্জান, দুরুছ কুরা, শুঁটকি, বেলা বিস্কুটের কথা উঠলে কোনো কথা নেই আঁরা চাটগাঁইয়া। এই শব্দগুলো এখন শুধু ঐতিহ্য বহন করে না চট্টগ্রাম অঞ্চলের রসনা জৌলুসের এক অনন্য ইতিহাস এবং লোকজ সংস্কৃতির অংশও বটে। দুরুছ কুরা নিয়ে একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম তালেব চাচার কাছে। পটিয়ার হাসির রাজা খ্যাত অভিনেতা তালেব সংকেত বলেছিলেন, বাঙালি জাতির কী বুদ্ধি আইসের পেছন বাঁশ দিয়ে নাম রেখেছেন আইসক্রিম। আমাদের চাটগাঁইয়ারা আস্ত মুরগি/ কুরা জবাই করে ছামড়া ছিলে নাড়িভুঁড়ি বের করে। শৈল্পিকভাবে মুরগির গলা–পা মুচড়িয়ে পেটের ভিতর ঢুকিয়ে নাম দিয়েছে দুরুছ কুরা। দুরুছ কুরা মানে বিয়ে বাড়িতে নতুন জামাই বা বেয়াই বেয়াইনের টেবিলে না থাকলে তুমুল ঝগড়া লাগে। একদা পলাশদের বাড়িতে খানাপিনার আয়োজন চলছিল। পাশে রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন কবিয়াল ইউসুফ ও তালেব চাচা। দুজনে আবার ভোজন রসিক। আবোলাইন্যা মেজ্জান পেলে কথা নেই দুজনে লুঙ্গির গিট্টু/প্যান্টের হুক খুলে দিয়ে গরুর গোশ টানতে পারে বেশ। ঐদিন রান্না করা মাংসের সুঘ্রাণ পেয়ে তালেব চাচা কবিয়াল ইউসুফ ভাইকে জড়িয়ে ধরে লাফ দিয়ে কোলে উঠতে গিয়ে দুজনে লুটোপুটি খেয়ে রাস্তা থেকে ধানের জমিতে পড়ে গেল। তালেব চাচার পরিধানের তহবন খুলে গেল। চাচার দিগম্বর কায়া দেখে কবি ইউসুফ ভাই হেসে খুন। উঠে তাড়াতাড়ি লুঙ্গির গিট্টু দিয়ে বলল, বন্ধু পলাশের বাড়িতে আয়োজন হচ্ছে দুরুছ কুরার সুঘ্রাণ আসছে। তালেব চাচা বলল, চল দুজনে আবোলাইন্যা গরবা সেজে খেতে যায়। তুই কনে পক্ষ আমি বর পক্ষ। বাড়িতে গিয়ে দুজনে বসে পড়লো বিশেষ মেহমানদের টেবিলে। খাবার টেবিলে কালো ভুনা, নেহারি, চিংড়ি, দুমাছা, কলিজা ভুনা, ডিম, নানা পদের মাছ আরো কত কী। সাথে আস্ত পাহাড়ি দুরুছ কুরা। আয়োজনটা ছিল জেয়াফত উপলক্ষ্যে নতুন বেয়াই বেয়াইন আসবে, সে জন্য দুরুছ কুরা ছিল অতিরিক্ত। দুজনে ভেবেছে বিয়ে বাড়ির খানাপিনা।
চুপি চুপি বিড়ালের মতো খেতে বসে গেল তুফানের গতিতে চলছে গাপুসগুপুস। দুরুছ কুরার সুগন্ধিতে দুজনে মাতাল। কে আগে নিবে দুরুসের রান, শুরু হলো টানাটানি জীবন্ত কুরা হলে এতক্ষণ কুকরুক কক কুকরুক কক বাক দিয়ে পুরো বাড়ি খবর করে দিত। কবি ইউসুফ বলল, বন্ধু দুরুছ কুরার মাথা হণ্ডে? তালেব চাচা বলল, মাথা পা সব তো কুরার পাছার ভিতর মুছড়িয়ে ঢুকিয়ে দিছে। দুরুছ কুরার মাথা খুঁজতে গিয়ে ডিম বেরিয়ে আসল। তালেব চাচা বলল, দুরুছের ভিতর সিদ্ধ ডিম কীভাবে এলো বন্ধু? এটা নিয়ে শুরু হলো যুদ্ধ? কবি ইউসুফ বলল, ভাই এটা নতুন জামাই বোকা না চালাক এটা পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছে। খবরদার ডিমটা খাইছ না তুই। মুরগির পাছার ভিতর ঢুকিয়ে দে। পলাশ দূর থেকে তাদের কাণ্ড দেখে কাছে এসে বলল, এই তোমরা কারা? কবি ইউসুফ ভাই বলল, জি ভাইয়া আমি বর পক্ষ, তালেব চাচা চিৎকার দিয়ে বলল, ভাই আমি কনে পক্ষ। পলাশ বলল, ভাই এসব কী বলছেন। ‘এটা আমার বাবার জেয়াফত অনুষ্ঠান। নতুন বেয়াই–বেয়াইন এর জন্য টেবিল সাজানো হয়েছে। অনরা তো আবোলাইন্যা চলাই দিয়ুন দুরুছ কুরা দি।’ দুজনে লজ্জা পেয়ে কাঁচুমাচু করতে লাগলেন। টেবিলে বসা মেহমানরা হা হা হা হি হি হেসে খুন।
চট্টগ্রামের ভোজনরসদ দুরুছ কুরার ডিশ নতুন বেয়াই–বেয়াইনের বা জামাইয়ের খাবারের মেনুতে না দিলে চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করেন বর পক্ষ। নতুন বর/কনের খাবারের মেনুতে দুরুছ কুরা না থাকলে আপনার আয়োজন হবে মাটি।
রসনা জৌলুসে সমগ্র দেশে চাটগাঁইয়াদের একটা সুনাম আছে। ভোজনরসিকে সমগ্র বাংলাদেশে চাটগাঁইয়ারা সেরা। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রামে আদিকাল থেকে সুফিসাধক, মোগল, আরকানি, পর্তুগিজ, ইংরেজ, আরবদেশ থেকে নানা জাতির আগমনের কারণে ভোজনরসদেও অন্য জেলার থেকে চট্টগ্রামের মানুষ একটু বেশি ভোজনবিলাসী। দুরুছ কুরা, মেজ্জান, বলীখেলা, সাম্পান, শুঁটকি, বেলা বিস্কুট, লবণের ঘ্রাণ মানে আঁরা চাটগাঁইয়া। দুরুছ কুরার প্রচলন আরাকানি আমল থেকে। দুরুছ কুরা অর্থ মুরগির মোসাল্লম। দুরুছ/মোসাম্মান মানে আস্ত রোস্ট। বাড়িতে বিশেষ মেহমান নতুন জামাই, বেয়াই বেয়াইন কিংবা বিয়ে বাড়িতে বিশেষ অতিথিকে আস্ত চামড়া ছিলা মুরগি রসালো ঝোল দিয়ে তৈরি আস্ত মুরগি পরিবেশন হচ্ছে দুরুছ কুরা। আরাকানের রোহিঙ্গারা এই দুরুছ কুরা বা আস্ত মুরগি দিয়ে গরবাদের (মেহমান) সমাদার (আপ্যায়ন) করে থাকে। দুরুছ কুরা মিশরীয়দেরও খুব প্রিয় খাবার। মিশরেও দুরুছ কুরার প্রচলন আছে।
চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ করে বান্দরবানসহ পার্বত্য জেলাগুলোতে বনমোরগ পাওয়া যেত। বন মোরগের মাংস দিয়ে সকালে বিনি ভাত কিংবা নতুন জামাই, বেয়াই বাড়ির ইস্টকুটুম আসলে মাঝারি সাইজের আস্ত মুরগির দুরুছ কুরা দিয়ে নতুন অতিথিদের মেহমানদারি করা হতো। পাহাড়ি গাছপালা নিধনের ফলে বনমোরগও বিলুপ্তের পথে। বনমোরগের বদলে এখন নানা জাতের কক, ব্রয়লার কুরা বা মোরগে বাজার দখলে। আজকাল বাণিজ্যিকভাবে মেজ্জানের মাংসের পাশাপাশি দুরুছ কুরা ও অভিজাত হোটেলে পাওয়া যাচ্ছে। দুরুছ কুরার ঝোলও বেশ সুস্বাদ ও সুঘ্রাণ হয়। চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী দুরুছ পোলাও নিয়ে লিখেছেন ‘জবাই করা আস্ত মুরগি, মরিচ ও মসলা সহযোগে সিদ্ধ করার পর আগুনে সেঁকে নিয়ে সরষে তেলে ভেজে নিলে দুরুছ প্রস্তুত হয়। সরিষার তেল বা ঘি মসলা পিঁয়াজ সহযোগে রান্না করা ভাত হলো পোলাও। এই শতকের তৃতীয় দশকের পর থেকে লোকের রুচি পরিবর্তনের ফলে দুরুছ পোলাও এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।’ ইবনে বতুতার (১৩০৪–১৩৬৮ খ্রি.) ভ্রমণ কাহিনিতে উল্লেখ আছে, সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ (১৩২৫–১৩৫২ খ্রি.) বিন তুঘলকের প্রিয় খাবার ছিলো দুরুছ কুরা। তবে নতুন জামাই এবং বিয়ে বাড়িতে বেয়াই বেয়াইন কিংবা সম্মানি মানুষের খাবার টেবিলে দুরুছ পরিবেশন হবে না এটা অসম্ভব। দুরুছ কুরা ছাড়া খাবারের মেনু পূর্ণ হয় না।
দুরুছ কুরার উপকরণ: আস্ত মুরগি একটি, পেঁয়াজ বাটা চার কাপ, জিরা বাটা এক চা চামচ, আদা বাটা তিন চা চামচ, গরম মসলা এক চা চামচ, জর্দার রং সিকি চা চামচ, হলুদ আধা চা চামচ, পোস্তবাটা এক চা চামচ, কাজুবাদাম বাটা এক টেবিল চামচ, লবণ ও তেল পরিমাণমতো, নারকেল বাটা সিকি এক কাপ, কিশমিশ পনেরো থেকে বিশটি, বেরেস্তার পিঁয়াজ এক কাপ, জায়ফল ৪টি, টক দই পাঁচ থেকে ছয় চামচ নিয়ে পেস্ট করে, কেউড়া জল এক টেবিল চামচ, দুধ এক কাপ, চিনি ১ চা চামচ, কিশমিশ ১০টি, কেওড়া জল ১ টেবিল চা চামচ। চামচ দিয়ে মেরিনেট করে চামড়া ছিলা আস্ত মুরগিটি দিয়ে দিন।
দুরুছ কুরা রন্ধন প্রণালি : আস্ত মুরগিটি ওজনে এক কেজি বা তার কিছু কম হলেও অসুবিধা নেই মিডিয়াম সাইজের। মুরগিটি জবাই করে চামড়া ছড়ানো হয়। মুরগির পাঁজরের দুই পাশে ছিদ্র করে রান দুটো ও গলা খাদ্যনালি বরাবর ঢুকিয়ে দিতে হবে। দুরুছ কুরা তৈরি করাও একটি শৈল্পিক কাজ। আস্ত মুরগিটি কাঁটা চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্র করুন। যাতে মসলা মুরগির শরীরে প্রবেশ করতে পারে। প্রস্তুতকৃত মুরগিটির ভেতরে বাইরে মসল্লা ভালো করে মেখে নিন। এবার আধঘণ্টা রেখে দিন। এবার আস্ত মুরগিটি সামান্য পানি দিয়ে পাত্রের মধ্যে ঢাকনা দিয়ে কষিয়ে নিন। সাবধানে কষাতে হবে মুরগিটি পুড়ে না যায়। তাই সিদ্ধ হওয়ার পনেরো বিশ মিনিট পর একটু নাড়াচাড়া করে দিন। মাংস সিদ্ধ হলে দুধ ও চিনি দিয়ে কিছুক্ষণ জাল দিন। চুলায় বাগাড়ের উপকরণগুলো ভেজে নিন। ভাজার জন্য তেল বা ঘি ব্যবহার করা যাবে। বেরেস্তার রং হয়ে এলে মসলা সহ আস্ত মুরগি পাত্রে রেখে ঢেকে দিয়ে বলক তুলুন। একদম লাল হয়ে গেলে আস্ত দুরুছ কুরাটি বেশ সুন্দর ও লোভনীয় দেখাবে। এবার চুলা থেকে নামিয়ে আপনার পছন্দমতো বড়ো বাটিতে করে পরিবেশন করেন।
তথ্য ঋণ : আবদুল হক চৌধুরীর রচনাবলী (চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা পৃষ্ঠা ৩২৯) ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।