মানুষের মৃত্যু হলেই সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায় না। প্রদীপ্ত চেতনার মানুষ সমাজদেহের ভেতর কাঠামোতে গভীর-গোপনে কাজ করে যায়। রশীদ হায়দার (১৯৪১-২০২০) ছিলেন সেরকম একজন মানুষ,ধীরসি’র স্বভাবের,যেন কোনো তাড়া নেই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁর অনুধ্যান। না, অন্যদের মতো তিনি চেতনাবাজ ছিলেন না। তাঁর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল সক্রিয় চেতনার অংশ। মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে তিনি লিখেছেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস- খাঁচায় (১৯৭৫) অন্ধকথামালা (১৯৮৭) নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য (১৯৮২)। সম্পাদনা করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ (১৯৮৫) ১৩ খণ্ডে স্মৃতি:১৯৭১ (১৯৮৮-২০০০) ভয়াবহ অভিজ্ঞতা (১৯৮৯) খুঁজে ফিরি (২০০০)। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল, শেখ আবদুর রশীদ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার । ডাক নাম দুলাল। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি রশীদ হায়দার নামে পরিচিত ও শ্রদ্ধেয় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান (১৯৬৪) স্নাতকোত্তর (১৯৬৫) পাস করার পর পেশা হিসেবে প্রথমে সংবাদিকতাকে বেছে নিলেও পরে বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগ দেন ১৯৭৩ সালে। আমি যখন ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে একজন প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে কাজ করি, তখন তিনি উত্তরাধিকার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। উত্তরাধিকার পত্রিকায় পূর্বেই আমার কয়েকটি লেখা প্রকাশের সূত্রে তিনি আমাকে নামে চিনতেন। আমি দেখেছি, অনুজ লেখকদের আপন করে নেয়ার এক দুর্লভ গুণ ছিল তাঁর মধ্যে। হাসতেন প্রাণ খুলে, রসবোধ ছিল উচ্চাঙ্গের। লেখক প্রকল্পের ছয়মাসের মধ্যে তাঁর সঙ্গে আমার একধরনের হৃদ্যতা তৈরি হয়, যা মৃত্যু-অবধি অক্ষুণ্নই ছিল। লেখক প্রকল্পে আমার কাজ ছিল ‘বাংলাদেশের কথাসাহিত্য:প্রবণতাসমূহ (১৯৯৭)’ রশীদ হায়দার নিজেও কথাসাহিত্যিক ছিলেন বলে নানা বিষয়ে মতবিনিময় সূত্রে সখ্যতা আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। তাঁর চাওপাওয়া ছিল খুব সীমিত, নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষটি প্রতি সহজে শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠতো। রশীদ হায়দার একাধারে কথাসাহিত্যিক, সম্পাদক, পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, নাট্যকার,অনুবাদক, সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেয়ার পর সর্বশেষ পরিচালক হিসেবে ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তারপর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এবং নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ষাটের দশকে উত্তাল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যুক্ত থাকার সুবাধে তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের প্রগাঢ় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর গল্পগ্রন্থ: নানকুর বোধি (১৯৬৭) অন্তরে ভিন্ন পুরুষ (১৯৭৩) মেঘেদের ঘরবাড়ি (১৯৮২) উত্তরকাল (১৯৮৭) আমার প্রেমের গল্প (১৯৮৮) পূর্বাপর (১৯৯৩) মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৯৯) ইত্যাদি নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৭০টি। রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫) উপন্যাসের পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এই নয় মাসে নিরাপত্তাহীন শ্বাসরুদ্ধকর ঢাকার জনজীবনের সঙ্গে শত্রু কবলিত বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ঢাকার মিরপুরে, তিনতলা একটি বাড়ির তিনটি ফ্লাটের পরিবার পরিজনকে নিয়ে রচিত হলেও যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের ব্যাপক পটভূমি ও জীবনবোধের সামগ্রিকতা এতে বিধৃত। উপন্যাস হিসাবে এটি সুপরিকল্পিত, কেননা এতে চরিত্রসমূহের বিকাশের অবকাশ নেই কিন্তু ভয়, আতঙ্ক,মানসিক চাপ খাঁচার রূপকে ফুটে উঠেছে।। অধ্যাপক তাহের, জাফর, মন্টুসহ আরো কয়েকজন মানুষ ত্রিতল ফ্লাটে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে সারাক্ষণ মুক্তির প্রত্যাশা করে। ভারতীয় বিমানকে মনে করে মুক্তির দূত, ইন্দিরা গান্ধীর বেতার ভাষণে তারা স্বাধীনতার আশ্বাস খোঁজে। তারা সবাই মুক্তি চায়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে কেউ অংশ নেয় না অথবা মধ্যবিত্তসুলভ স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের কারণে যুদ্ধে যেতে পারে না।। তারা দিব্বি অফিসে যায়, চাকরি করে, কখনো তাস খেলে, চা-কফি পান করে, ঘন ঘন রেডিও শোনে। অর্থাৎ বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসরূপ খুব স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে খাঁচায় উপন্যাসে। যেমন-
বাড়ি ভর্তি লোক, তিনতলায় ভাড়াটে ইতিহাসের অধ্যাপক তাহের সাহেব, তাঁর স্ত্রী, দু’টি ছেলে, বছর বিশেক বয়সের বোন কুমু, দোতলায় বিধবা বুবুর পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে, লিলির সেজো বোনের মেডিক্যাল পড়া ছেলে কামরুল ও মেজো বোনের ম্যালেরিয়া এরাডিকেশনে চাকরি করা মেয়ে সাঈদা, নীচতলায় বুবুর শাশুড়ি, বড় ননদ, তার ছেলে ফিরোজ চাচা, বৌ ও ছোট ছোট সাত আটটা ছেলেমেয়ে, মাস কয়েক আগে বিয়ে করা সুন্দরী বৌসহ মন্টু। …ভারী মজার মানুষ মন্টু, দেশের উপর দিয়ে এতো তাণ্ডব যাচ্ছে কোন কিছুই যেন স্পর্শ করে না ওকে। চেঞ্জারে রেকর্ড চাপিয়ে গান শুনে, টেলিভিশনে মজার প্রোগ্রাম দেখলে প্রাণ খুলে হাসে হো হো হো করে (খাঁচায়/ রশীদ হায়দার, পৃষ্ঠা: ৩৯)।
উপন্যাসের নাম খাঁচায় শত্রুকবলিত নগরীর তিনটি ফ্লাটের অবরুদ্ধ জীবনকে ঔপন্যাসিক প্রতীকী তাৎপর্যে ব্যবহার করে খাঁচায় নামকরণ করেছেন। যদিও উপন্যাসে একটি টিয়ে পাখির কথা আছে যেটিকে জাফরের ভাই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পর ফিরে এসে খাঁচার মুখ খুলে মুক্ত করে আকাশে উড়িয়ে দেয়। কিন্থু টিয়ে পাখিটি উড়তে পারে না, মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়, মুক্তিযোদ্ধা আবিদ মাটিতে পড়ে যাওয়া পাখিটিকে আবার উড়িয়ে দিতে দৌড়ে যায় এবং এভাবে উপন্যাসটির পরিণতি টানা হয়েছে। বস্তুত আমাদের স্বাধীনতা উপন্যাসে বর্ণিত টিয়ে পাখিটির মতোই, উড়তে গিয়েও মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পাখিটির উল্লেখের মধ্যে একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা আছে, যেটি এই উপন্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীকী তাৎপর্য এনে দিয়েছে। এ উপন্যাসে রশীদ হায়দার হানাদার কবলিত বাংলাদেশকে খাঁচার প্রতীকে উপস্থাপন করেছেন। আবার কখনো মনে হয়েছে অধ্যাপক তাহের, জাফর, লিলি, মন্টুসহ পুরোপরিবার যে বাড়িতে শ্বাসরুদ্ধকর জীবন কাটাচ্ছে এ বাড়িটাই একটা খাঁচা। একাত্তরে হানাদার কবলিত বাংলাদেশ খাঁচার সদৃশ হয়ে ওঠেছে লেখকের বর্ণনায়। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নেয়ায় জাফর আত্মগ্লানিতে ভোগে-
ওরা মুক্তিবাহিনীতে। হঠাৎ জাফরের সোনার টুকরা বলে মনে হয় ওদের; না খেয়ে না দেয়ে দিনের আরাম রাতের ঘুম হারাম করে স্টেনগান কাঁধে যুদ্ধ করছে, ওদের স্পর্শে দেশের মাটি ধন্য, ওরা যেন নক্ষত্রের মতো অনন্ত ও দীপ্যমান। নিজেকে বড্ড ছোট লাগে ওদের তুলনায়; (খাঁচায়/ পৃষ্ঠা: ৪০)।
খাঁচায় উপন্যাসে সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধার কথা যেমন আছে, তেমনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পারার গ্লানিতে দগ্ধ মধ্যবিত্ত চরিত্রের অন্তর্দাহ আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফের মতো অনেকে ব্যাংক অপারেশনের খবর শুনে হতাশায় ভেঙে পড়ার কথা আছে। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের এই মানস প্রবণতা খুব চমৎকারভাবে রূপায়িত হয়েছে খাঁচায় উপন্যাসে।
রশীদ হায়দারের প্রথম দিনে গল্পেও পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদারদের প্রথম আক্রমণে ভীত-সন্ত্রস্ত নগরীর মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। ঢাকায় রাজারবাগেই প্রথম গুলি বর্ষিত হয়। গল্পে রাজারবাগের ওদিকে থাকে বাদশার বোন রাবেয়ার বাসা। সেদিকে গুলির আওয়াজ শুনে বিচলিত হয়ে ওঠে বাদশার মা, সে কিছুতেই প্রবোধ মানতে চায় না। বারবার বাদশাকে তাড়া দেয় রাবেয়ার খোঁজ নেয়ার জন্য। কিন্তু বাইরে বের হওয়া কার সাধ্য। গুলির আওয়াজ একটু কমতেই বাদশা বোনের খোঁজে বের হয় কিন্তু রাস্তায় বেরুতেই পাশের ফ্লাটের আকমল সাহেব সজোরে ডাকে এবং বের হতে নিষেধ করে। আকমল সাহেবের কাছেই বাদশা শুনতে পায় কমান্ডার আলতাফকে ধরে নিয়ে গেছে। এভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুরো শহরটা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়ে যায়। রশীদ হায়দারের গল্পে যেমন অবরুদ্ধ মানুষের উদ্ধিগ্ন অবস্থা, পাড়ার লোক ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ আমরা পাই । এগল্পে শত্রুকবলিত ঢাকা নগরীর অবরুদ্ধ অবস্থা ও পাড়া থেকে মেয়ে তুলে নেয়ার চিত্র দেখতে পাই-
লেক সার্কাসে ক’ঘর ফ্যামিলি বাইরে দরজার তালা বন্ধ, ঘর অন্ধকার রেখে রাত কাটাচ্ছিল। ফোন বাজাতে রিসিভার তুলতেই ধরা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মিলেটারীর লরী এসে দাঁড়িয়ে গেল বাড়ির সামনে। ওরা কাউকে কিছু বলেনি। লরীতে একজন মেজর ছিল, সে কেবল সোনিয়াকে নিয়ে গেছে।
এ গল্পটি আন্তর্জাতিক পটভূমিতে চিত্রিত। হিটলার যে রকম প্যারিস দখল করে জার্মান সৈন্যদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল, আর জার্মান সৈন্যরা যেমন যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে ফূর্তি করেছে, ঠিক তেমনি ইয়াহিয়া ঢাকা নগরী দখল করে পাঞ্জাবিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবিরাও তেমনি পাড়া থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে চরিতার্থ করেছে পশুবৃত্তি। ‘অন্ধকথামালা’ গ্রামীণ পটভূমিতে মুক্তিযোদ্ধা ও শান্তিবাহিনির তৎপরতা চিত্রয়িত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিরা কীভাবে মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ছিল, যার কারণে স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রলম্বিত হয়েছে। তবে লেখকের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন সবসময় জাগুরুক ছিল-
‘ মানুষ অদৃশ্য হলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। মানুষকে দেখতে না পেলেও মানতেই হবে সে আছে আশেপাশে। আশপাশ বেরিয়ে বলবে,আমি নদীর তরঙ্গ দেখছিলাম,আমি কালকুলে নাচন প্রত্যক্ষ করছিলাম,আমি মোসলেম হোমিওর মেয়ে শরিফাকে দেখতে গিয়েছিলাম,আমি দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম।’
এই যে চেতনা, তার এমন সজীব রূপায়ন খুব কম লেখকের লেখায় পাওয় যায়। ‘অন্ধকথামালা’র পর তাঁর ‘নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য’ উপন্যাসে রশীদ হাদারের পর্যবেক্ষণ ভিন্ন রকম হয়। তিনি দেখেন মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, আদর্শচ্যুতি, অবক্ষয়, স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান ইত্যাদি। রশীদ হায়দারের কথাসাহিত্যেও মূল বিষয় হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অস্তিত্ব সংকট,মূল্যবোধের অবক্ষয়,জীবনের নানা টানাপোড়েনকে তিনি দক্ষ শিল্পীর মতো চিত্রায়িত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি যেমন সৃজনশীল চেতনায় রূপায়িত করেছেন তেমনি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ’ এবং ‘স্মৃতি:১৯৭১’ কাজের জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার,একুশে পদক ২০১৪,হূমায়ুন কাদির পুরস্কার ১৯৮৭,ও রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা পান ২০০৪ সালে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশ্বাসী এই কথাসাহিত্যিক, লেখক,গবেষক রশীদ হায়দারের বিদেহী আত্মার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।