জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াসহ নানা কারণে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। আগামী ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রজাতির বাঘ বিলুপ্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই পরিস্থিতিতে সংরক্ষিত বনের ভেতর গড়ে তোলা কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে এই বাঘের প্রজননে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানান, দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত দিক দিয়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বন হচ্ছে কক্সবাজারের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ২০০০ সালে এই বনাঞ্চলের ডুলাহাজারায় প্রায় ৯০০ হেক্টর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। প্রতিষ্ঠার পর সামান্য জায়গায় বাঘের বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় এবং সেই আবদ্ধ বেষ্টনীই বাঘের আবাসস্থল হয়ে ওঠে। কয়েক বছর পর পর সেই বেষ্টনীতে বাঘের প্রজনন হয়ে আসছিল। কিন্তু প্রজনন হলেও বাঘের দেখভাল করাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করাটা ছিল দুরূহ। তবে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে গড়ে তোলা এই পার্কটি প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তরের জন্য সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেয় এবং শতাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেইভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। বর্তমানে পার্কের ৭৫ একর জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল আয়তনের বাঘের বেষ্টনী। এই বেষ্টনীতে বাঘ উন্মুক্তভাবে বিচরণ করবে আর দর্শনার্থীরা খাঁচায় বন্দি হয়ে বাঘের উন্মুক্ত বিচরণসহ জীবনাচার প্রত্যক্ষ করতে পারবে। কিন্তু প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি একটি কারণে স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের সবকিছু সম্পন্ন হলেও প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তর হতে বর্তমানে বাধা কোথায়? এমন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বর্তমানে এই পার্কটি প্রকৃত সাফারি পার্কে রূপান্তর হওয়া একেবারে সময়ের ব্যাপার মাত্র। গত দুই অর্থবছরে এই পার্কে অবকাঠামোগত উন্নয়নে শতাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ একর বনের জায়গাজুড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার যাতে উন্মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে সেজন্য নির্মাণ করা হয়েছে বাঘের বেষ্টনী। এতে ইনার বেরিয়ার (অভ্যন্তরীণ বেষ্টনী) ও ১০ ফুট দূরত্বের পর প্যারিফেরি ওয়াল (১৫ ফুট উঁচু দেয়াল) নির্মাণ, সিকিউরিটি টাওয়ার নির্মাণ, আধুনিক মানের প্রশস্ত সড়ক নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক সমুদয় কাজ সম্পন্ন হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু পার্কে আগত দেশি–বিদেশি পর্যটক–দর্শনার্থীরা যাতে খাঁচায় বন্দি হয়ে পার্ক ভ্রমণ করতে পারে সেজন্য চাহিদার বিপরীতে দুটি ভ্রমণ বাস এখনো বরাদ্দ মেলেনি। মূলত দুটি ভ্রমণ বাসের অভাবে এই সাফারি পার্কটি প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তরের বিষয়টি স্থবির হয়ে রয়েছে।
বাঘের প্রজননের সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে বাঘের বেষ্টনীর আয়তন হচ্ছে ৭৫ একর। একইভাবে সিংহের বেষ্টনীও তৈরি করা হয়েছে। যদি এই বেষ্টনীতে বাঘ দিন–রাত তার নিয়মে বিচরণ, শিকার, বিশ্রামসহ আবাসস্থল তৈরি করে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তাহলে বাঘের প্রজননে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে এই সাফারি পার্ক।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই সাফারি পার্কে বাঘের প্রজননের চিত্র তুলে ধরা হয়। সরবরাহকৃত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪–০৫ অর্থবছরে ঢাকার চিড়িয়াখানা থেকে বিপরীত লিঙ্গের এক জোড়া বাঘ সরবরাহ করা হয় পার্কটিতে। কিন্তু বাঘ দুটির বার্ধক্যের কারণে প্রজনন আসেনি। পরবর্তীতে বার্ধক্যজনিত কারণে এগুলো মারা পড়ে। ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী পাচারকারী দলের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া দুই মাস বয়সের তিনটি ব্যাঘ্রশাবক ভাই–বোন জয়, জুঁই ও জ্যোতিকে প্রেরণ করা হয় চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। এরপর ৬ মাস পর্যন্ত পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইন শেডে রেখে যত্নের পর দুই বছরের মাথায় তিন শাবকের মধ্যে জ্যোতিকে জাপান প্রেরণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার চিড়িয়াখানায়। তবে শেষ পর্যন্ত জাপান যাওয়া হয়নি।
এদিকে পার্কে থাকা দুই ভাই–বোন জয় ও জুঁই তিন বছর পর আবদ্ধ পরিবেশে তাদের মেলবন্ধনে জন্ম নেয় দুই শাবক নয়ন ও রাণী। এর মধ্যে বেষ্টনীর ভেতর অভিযোজন তথা ভয়জনিত (হৃদাক্রান্ত) শকের কারণে মারা পড়ে রাণী। এরপর নয়ন একা হয়ে গেলে তার সঙ্গে রাখা হয় পার্কে আনা আফ্রিকান প্রজাতির আঁখিকে। কিন্তু আঁখির প্রজনন ক্ষমতাও এরই মধ্যে পেরিয়ে যায়। এতে আর বাঘের প্রজননে সফলতা আসেনি।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রধান বন্যপ্রাণী চিকিৎসক (ভেটেরিনারি সার্জন) হাতেম সাজ্জাদ জুলকার নাইন আজাদীকে বলেন, বর্তমানে পার্কে দুই জোড়া বিপরীত লিঙ্গের বাঘ থাকলেও সামান্য পরিসরের বেষ্টনীসহ নানা কারণে প্রজননের ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখেনি এই পার্ক। এই পরিস্থিতিতে সাফারি পার্কটি যদি প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তর হয়ে যায় তাহলে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিশাল এলাকায় গড়ে তোলা বেষ্টনীতে উন্মুক্তভাবে স্বাভাবিক বিচরণ, শিকার, বিশ্রামসহ আবাসস্থল (বাচ্চা দেওয়ার জন্য) তৈরি করে নিতে পারবে। সেই উপযুক্ত পরিবেশ হলেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রজননে বিরাট সফলতা দেখাতে পারবে এই পার্ক।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের এক সময়ের প্রকল্প পরিচালক ড. তপন কুমার দে আজাদীকে বলেন, সুন্দরবনের পর দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক, পরিবেশগতসহ জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ চিরহরিৎ সংরক্ষিত বনেও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রজনন হয়েছে। আর সেই পরিবেশ বজায় রয়েছে চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কেও। এই পার্কটিকে যদি সঠিকভাবে প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তর করা যায় তাহলে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রজননে বিরাট সফলতা দেখাবে। এই বিষয়টিতে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি দেওয়া উচিত।
চকরিয়ার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, এই পার্কে বর্তমানে দুই জোড়া বিপরীত লিঙ্গের বাঘ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও অপরটি আফ্রিকান প্রজাতির। আগামীতে একটি পুরুষ ও দুটি স্ত্রী লিঙ্গের বাঘ আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে চাহিদা অনুযায়ী দুটি বাসও বরাদ্দ পাওয়া যাবে। এরপর প্রকৃত সাফারিতে রূপান্তর হয়ে যাবে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কটি। তখন উপযুক্ত আবাসস্থল তৈরিসহ স্বাভাবিক পরিবেশে বনের ভেতর বাঘগুলো বিচরণ করতে পারলে বাঘের প্রজননে সফলতা আসবে। আমরা সেই সময়ের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।