মুসলমানদের জন্য মাহে রমজান একটি পবিত্র মাস। এই মাস সংযম, ধৈর্য, সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও কল্যাণ কামনার মাস। মুসলমানতো বটেই অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সাধারণ মানুষও এই মাসকে পবিত্র ও সম্মানের চোখে দেখে। বলা হয় – এই মাসে দান খয়রাত করলে তার প্রতিদান বেশী। রাতের বেলায় খাবার-দাবারের প্রাচুর্যও কিছুটা অনুমোদিত। বিশেষ করে রোজাদারকে ইফতার করানো বা আপ্যায়ন করা বড়ই পুণ্যের কাজ। আরো বলা হয় – এই মাসের অতিরিক্ত খরচকে তছরুপ বা অপচয় হিসেবে ধরা হবে না । কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এই নির্দেশ বা নিয়মগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বা ব্যবহার আমাদের সমাজের খুব কম সংখ্যক লোকের জানা আছে। জনগণের বিরাট অংশ এসবের ভুল ব্যাখ্যার আচরণে অভস্ত। ধর্মের বাণী প্রচার করার জন্য যারা বিশেষভাবে চিহ্নিত এবং সম্মানিত, তাঁরা অর্থাৎ দায়িত্ব বহনকারীরা, নিজেরাই এ ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানের অধিকারী কিনা তারও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। যাক আমি ওদিকে যাব না। বেশ কয়েক বৎসর আগে ডেইলি স্টারের একটি সাপ্তাহিক প্রকাশনায় প্রকাশিত ২টি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই।
এক যুবকের বক্তব্য – “দুপুর ২টার সময় আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। রাস্তার পাশে তাকে বসিয়ে রেখে রিক্সা বা টেক্সি খুঁজতে থাকলাম। গন্তব্য খুব কাছে হওয়ায় একটা টেক্সিও যেতে রাজি হয় না। খালি রিক্সা পেতেও অনেক দেরী হচ্ছে। এদিকে মা ছটফট করছেন। একটি খালি রিঙা পেয়ে তাতে ওঠতে চাইলে ড্রাইভার বলল, আগে দরদাম করেন। ঐ জায়গার ভাড়া কত জানতে চাইলে সে বলল, ৮০ টাকা। তাকে বললাম, সাধারণত এর ভাড়া মাত্র ৩০ টাকা। আমার মা যেহেতু কাতরাচ্ছেন, আপনি ৫০ টাকা নেন। কিন্তু ৮০ টাকা মানে এত বেশী চাচ্ছেন কেন? ড্রাইভার বলল, সেই দিন নাই, এখন রোজার মাস। আমি আশ্চর্য হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ইতিমধ্যে রিঙা চলে গেল। এরপরই আর একটা রিঙা পেলাম তার কাছ থেকে ভাড়া জানতে চাইলে সেও ৮০ টাকা বলল, অনন্যোপায় হয়ে তার রিক্সায় মাকে উঠালাম।
রোজার মাস, সহজে নিকটস্থ যেকোন খাদ্যের স্বাদ-গন্ধ খুব প্রকটভাবে ধরা দেয়। তেমনি গাড়িতে উঠার সময় রিক্সাওয়ালার মুখ থেকে প্রচণ্ড সিগারেটের গন্ধ পেলাম। মনে করলাম খেটে খাওয়া মানুষ রোজা রাখতে পারে নাই। রিঙায় বসে এত ভাড়া চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে বলল, রোজার দিন কষ্ট করে রিঙা চালাই, বাচ্চাকাচ্চাদের ভাল খাবার দিতে হয়, ঈদের কেনাকাটা আছে, সব মিলিয়ে স্বাভাবিক সময়ের তিনগুণ ভাড়া নিলেও পোষায় না। আপনারা বড় মানুষ আপনাদের আল্লাহ দিবে, আর আমাদেরকে আপনারা না দিলে আমরা পাব কোথায়? মনে মনে ভাবলাম, টাকা আমাদেরকে আল্লাহ দিক বা না দিক, আমাদের জন্য আল্লাহ আছে। কিন্তু তাদের ধারণা এই যে, আল্লাহ তাদের জন্য নাই। এসব কথা আর ধর্মীয় বাস্তবতার ফারাকটা ঘোচাতে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ধর্মীয় সভ্যতার আর কতপথ এখনো সামনে পড়ে আছে আমরা জানি না।’
অন্য একটি যুবকের কথা (২০০৫ সাল) – ‘আমরা একটা বাসায় ভাড়া থাকি। বাড়িওয়ালা ও তার স্ত্রী বেশ ভদ্র, আমাদের সাথে সুবচনে আলাপ করেন। আমরা তিন ভাই প্রতি ওয়াক্ত নামাজ পড়ি কিনা বা পড়েছি কিনা বার বার জানতে চান। তাদের ভাল ব্যবহারের সাথে বেশ গরমিল লাগে, যখন দেখি ২৪ ঘন্টার মধ্যে অন্তত ১০ বার কলে পানি থাকে না। রান্না ঘরে কাজের মেয়েকে ঘন্টার পর ঘন্টা পানির অভাবে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। বার বার বলা সত্ত্বেও কিছুক্ষণের জন্য পানি ছাড়ে, ঐ পানি পাত্রে ভরে রেখে খুব কম কম করে ব্যবহার করতে হয়। বাসা ভাড়া ১৪ হাজার টাকা। বাড়ীওয়ালী ওয়াজ করেন, সবকিছুর সাশ্রয় করা দরকার। আমার মা খুব শান্ত মহিলা, অনেক চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় পানি ছাড়া চলা যায় না – এই কথাটা তিনি বাড়ির মালিককে বলতে পারেন না। তাঁর লজ্জা পায়। বাড়িওয়ালীর সংসার ছোট, ছেলেমেয়ে সাথে থাকে না। নিকটেই তার বাপের বাড়ি। কথায় কথায় বলেন, তিনি বাপের বাড়ি থেকে সব রান্না করে আনেন। ফ্রিজে রাখেন আর গরম দিয়ে খান। তিনি যখন বাপের বাড়ি যান তখন আমাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়। তারা বেমালুম ভুলে যায় যে বাসার ভাড়াটিয়াদের জন্য পানি ছাড়া দরকার। সাধারণত সহ্যের মাত্রা কতটুকু থাকা দরকার জানি না। তবে আমরা এখন প্রায় সহ্যহীন হয়ে উঠছি। ইতিমধ্যে আমাদেরকে বাড়িওয়ালী ইফ্তারির দাওয়াত দিলেন। খুব আন্তরিক দাওয়াত, সবাইকে যেতে হবে। ভাবলাম দাওয়াত গ্রহণ করলে হয়তো অন্তত ভাড়াটিয়াকে প্রয়োজনীয় পানি দেয়ার আন্তরিকতাটা পাওয়া যেতে পারে। সন্ধ্যায় আমরা সবাই নীচতলায় তাদের বাসায় গেলাম। ইফতারির আয়োজন যথেষ্টের চাইতেও ঢের বেশী। ইফতারের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার পূর্ব মূহূর্তে বাড়িওয়ালী বললেন, আমরা ইফতার করে কিছু খাই না। একটু পানি খেয়ে নামাজ পড়ে, এক ঘন্টা পর খাওয়া শুরু করি। এই কথা বলে আমাদের সামনে একটু পানি পান করে ভিতরে চলে গেলেন। পরিবেশটা অসুন্দর হলেও আমরা তাদের নিয়মিত অভ্যাসে বাধ সাধলাম না। নিজেরা নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে যা খাওয়া দরকার খেয়ে বাসায় চলে গেলাম। রাত ১০টা থেকে আমাদের ঘরে সবাই অসুন্থ হয়ে পড়লেন। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে কোন প্রকারে বেঁচে গেলাম। শেষ রাতে সেহেরী খাওয়ার উপযুক্ত ছিলাম না। স্বাভাবিক হতে দুদিন সময় লাগল। আমার মেঝভাই চালাক লোক। বাড়িওয়ালীর ছোট কাজের মেয়েটা ছাদের উপরে কাপড় শুকাতে দিয়ে নামার সময় তাকে ডাকল। রমজানের দিনের পুরস্কার স্বরূপ হাতে ৫০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে তারপর বলল- বাড়ীওয়ালীকে বলার দরকার নেই। তবে ঐদিন বাড়ীওয়ালী ইফতার না করে আমাদের সামনে থেকে চলে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটি এদিক-ওদিক চেয়ে বলল, “তারা স্বামী-স্ত্রীর জন্য আলাদা ইফতারী তৈরী করা হয়েছিল। তারা বেড রুমে সেগুলি খেয়েছে। আর প্রতিদিন তারা ইফতারী করে যা অতিরিক্ত থাকে এবং বিভিন্ন ঘর থেকে (উপহার স্বরূপ) যা ইফতারী আসে সব ফ্রীজে জমা ছিল। আপনাদেরকে সেগুলোই গরম করে খাওয়ানো হয়েছে”। একথাটা শোনার পর মা সব কথার এক কথাটা বললেন, এই বাসাটি যত তাড়াতাড়ি পার ছেড়ে দাও। এরা যে কোন সময় আমাদেকে মেরে ফেলতে পারবে।’
প্রিয় পাঠক, রমজান মাসে সিয়াম সাধনের তাৎপর্য অনুযায়ী আচরণ ও রোজাদারদের ইফতার করানোর অনেক সুখকর বা কল্যাণময় ঘটনার কথা আমাদের সবার জানা আছে। কিন্তু আমি এই লেখায় ব্যতিক্রম কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি। বিষয়টি এভাবে নিবেদন করতে পারি – উপকার করতে পারবে না বা চাও না তো নীরব থাক, কিন্তু উপকার বা ভাল কাজের বাহানা দিয়ে কারো অপকার করতে যেও না। এতে মানুষ উপকৃত তো হবেই না বরং প্রতারিত হয়। যা পবিত্র রমজান মাসে তো নয়-ই, অন্য কোন মাসে করাটাও কঠিন পাপ। এ মাহে রমজানে আমাদের বিশেষ প্রার্থনা হতে পারে – মহান সৃষ্টিকর্তা পরম দয়ালু আল্লাহ আমাদেরকে এই জঘণ্য পাপাচরণ থেকে বিরত রাখুন, কল্যাণকর কাজ করার সামর্থ্য দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষানুরাগী, সমাজব্রতী