রবীন্দ্রসাহিত্যে বর্ষা

পিংকু দাশ | রবিবার , ৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার প্রকৃতি, বাংলার ঋতু এবং বাংলার গ্রামীণ সৌন্দর্যকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্পে। ঋতুভিত্তিক গল্পগুলোতে বর্ষার সাথে বিরহের, বসন্তের সাথে মিলনের যোগসূত্র দেখতে পাই। বর্ষাকে বাংলা সাহিত্যে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বর্ষা বন্দনা এতটাই সমৃদ্ধ এবং হৃদয়গ্রাহী যে বর্ষা উদযাপনে কবিগুরুর আর কোনো বিকল্প নেই। তাই মনে করা হয় কবিগুরুর প্রিয় ঋতু বর্ষা।

গ্রামবাংলায় বর্ষাবরণের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছিল জমিদারি দেখাশোনার সুবাদে যখন তিনি শিলাইদহসাজাদপুরপতিসরে আসা যাওয়া করতেন। সেই আসা যাওয়ার সুবাদে বর্ষণপ্রধান গ্রামবাংলা কবির মনকে এতোটাই আবিষ্ট করে যে কবির কল্পনায়, ভাবনায়, বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখা কবিতা, গান এবং ছোটগল্পে আমরা তার প্রমাণ পাই। ‘বসন্ত ও বর্ষার’ নিবন্ধে কবিগুরু বর্ষার চরিত্র বর্ণনা করেছেন এইভাবে– ‘বসন্ত উদাসীন, গৃহত্যাগী। বর্ষা সংসারী, গৃহী। বসন্ত আমাদের মনকে চারিদিকে বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়, বর্ষা তাহাকে এক স্থানে ঘনীভূত করিয়া রাখে।’

ছোটগল্পের প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বর্ষার সঙ্গে দুঃখ বেদনার যোগ লক্ষ করা যায়। মানব জীবনে রুঢ় বাস্তবতাকে কবি নিবিড় বর্ষা, গ্রাম বাংলার পটভূমিকায় দেখিয়েছেন। আকাশে যখন মেঘের ঘনঘটা, চারিদিকে আবছা আঁধার তখন অজ্ঞাত কারণেই মন বিষাদে ভরে যায়। তাই মনে করা হয় বর্ষা ঋতু বুঝি বিষাদবিষণ্নতারই। এই বিষাদবিষণ্নতা বা বিচ্ছেদবেদনার নানারূপ নানা চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে কবিগুরুর বিভিন্ন ছোটগল্পে।

মধ্যবর্তিনী’র হরসুন্দরী যখন স্বামীর প্রীতিভালোবাসা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে, শৈলবালাকে সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিয়ে সংসারে দাসীর পর্যায়ে নেমে গেছে, যখন সে গোপন বেদনায় পর্যুদস্ত তখন দেখা যায় বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে।

একদিন ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছে। হরসুন্দরী আপনার নতুন শয়নগৃহের নির্জন অন্ধকারে জানলার কাছে চুপ করিয়া বসিয়া আছে’। ঠিক সেসময় তার স্বামী আসছিল অনেকটা চোরের মত, ছলে, কৌশলে ছোট বৌ শৈলবালার জন্য তার গহনাগুলো সংগ্রহ করতে।

পোস্টমাস্টার’ গল্পে বর্ষার বর্ণনার পরই আমরা দেখি পোস্টমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর একটু সুস্থ হলে বদলির জন্য মনস্থির করে শেষমেষ চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে রতনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে।

গল্পের শেষের দিকে পোস্টমাস্টার যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিল -‘যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্ররাশির মতো চারিদিকে ছলছল করিতে লাগিল’গ্রামের সেই বালিকা রতনের জন্য গভীর হাহাকার বুঝাতেও কবিগুরু বর্ষাকে তুলে এনেছেন।

বর্ষার একচ্ছত্র আধিপত্য ‘শাস্তি’ গল্পেও। গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহের নিঁখুত ছবি এই শাস্তি গল্পটি। পুরো গল্পেই হাহাকার, না পাওয়ার বেদনা এবং শূন্যতা।

অর্থনৈতিক অব্যবস্থার দুর্বিপাকে পড়া দুখিরাম ও ছিদাম সেদিন মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিন জমিদারের কাছারি ঘরে কাজ করেছে। তারপরেই বাড়ি ফিরে ক্ষুধার্ত দুখিরাম স্ত্রীর শ্লেষবাক্যে বিক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হয়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে স্ত্রীহত্যার ভাগী হয়ে পড়ে। গল্পের শেষে চন্দরাকে ডেপুটি মেজিস্ট্রেট যখন সেশনে চালান দিলেন তখনও ‘পূর্ব বৎসরের মতো নবীন ধান্যক্ষেত্রে শ্রাবণের অবিরল বৃষ্টিধারা বর্ষিত হইতে লাগিল’।

ছুটিগল্পের ফটিক শহরের জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে জ্বরাক্রান্ত শরীরে মায়ের কাছে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে। সেদিন আবার রাত্রি হইতে মুষলধারে শ্রাবণের বৃষ্টি পড়িতেছে। ‘প্রচণ্ড জ্বর বিকারগ্রস্ত অবস্থায় যখন পুলিশ তাকে উদ্ধার করে আনে তখনো ঝুপ্‌ ঝুপ্‌ করিয়া অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়িতেছে।’

বর্ষার সঙ্গে কেবল বিরহ বা হাহাকারের যোগ রবীন্দ্রকাব্যে শেষ কথা নয়। মাঝে মাঝে মিলনের যোগসূত্রও আমরা দেখতে পাই। ‘সমাপ্তি’ এবং ‘একরাত্রি’ গল্প দুটিতে দেখা যায় বর্ষা কেবলই বিরহের উদ্দীপন বিভাব নয়, মিলনেরও যোগ আছে।

সমাপ্তিগল্পে দুরন্ত মৃন্ময়ীর অভাবনীয়, আমূল পরিবর্তন খুব সুন্দরভাবে ঘটানো হয়েছে। গল্পের শেষে মৃন্ময়ী যখন মিলন শয়নে স্বামীকে বাহুপাশে আবদ্ধ করেছে তখন ইতিমধ্যেই কিন্তু ‘প্রবল বেগে বাতাস উঠিয়া বৃষ্টি আরম্ভ’ হয়ে গেছে। এখানে বিরহ অবসানে বর্ষার পটভূমিকা রচিত হয়েছে।

কবিগুরু তাঁর, গানে, গদ্যে সর্বত্রই বর্ষাকে তুলে এনেছেন ভালোবেসে। বর্ষা ঋতুর গানে কল্পিত বিচ্ছেদ বেদনা বা বিষণ্নতার সুর নানাভাবে প্রকাশ পায়। সে বিষণ্নতার কারণ কচিৎ জানা, প্রায় সর্বদাই অজানা। তাঁর বর্ষা ঋতুর গান এতটাই জনপ্রিয় যা শ্রোতাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। গীতবিতানের অন্তর্ভুক্ত প্রকৃতি বিষয়ক গানের মধ্যে বর্ষা ঋতুর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় ১৩৪ অথবা ১৩৫। এতে কবির বর্ষাপ্রীতির পরিচয় মেলে। ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মহীরূহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্য সংস্কৃতির এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কবিগুরুর ছোঁয়া লাগেনি। জীবনের শেষ দশকগুলোতে বর্ষামঙ্গল উৎসবে তাঁর রচিত বর্ষার কালজয়ী গানগুলো আজও প্রেম বিরহী মনে, রোমান্টিকতায়, কাব্যমাধুর্যে উদ্ভাসিত হয়ে থাকবে আজীবন।

বর্ষার বিপর্যস্ত জনপদের সাথে গ্রামবাংলার সৌন্দর্য যা কবির কবিতা এবং ছোটগল্পগুলোকে নান্দনিকতায় পূর্ণ করে তুলেছে। বর্ষাকে ভালোবেসে অমর সাহিত্য রচনা করেছেন কবি। ভালোবাসার কারণেই হয়ত কবির পরলোক গমন বর্ষা ঋতুতেই হয়েছে। তথ্যসূত্র: ‘গল্প গুচ্ছ’রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা’আনোয়ার পাশা, ‘বর্ষাবর্ষণের রূপচিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’আহমদ রফিক।

লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর চলচ্চিত্রচিন্তা