রবীন্দ্র রচনাবলীতে রবীন্দ্র সঙ্গীত একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য প্রাণস্পর্শী দিক। যা রবীন্দ্র নাথকে সৃষ্টিতত্ত্বে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী রূপের অবয়বের উম্মোচন করেছেন। হৃদয়গ্রাহী সুর সংযোজনা, শব্দচয়নে, কণ্ঠশৈলিতে বাঙালি ও বিশ্ববাসীকে নন্দিত করেছেন। বাংলার সঙ্গীতের ইতিহাসে ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’ নিজস্ব রস, রূপে গুণে স্থান করে নিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের। এক নব আঙ্গিকে নবধারার সুরের আবহে, নিজস্বতার বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুকণ্ঠী একজন গায়ক। তাঁর রচনা ও সুর সংযোজনা ঈশ্বর প্রদত্ত এক নান্দনিক রূপলীলা। যে গানের ভাষা, হৃদয়ঙ্গমভাব, সুরের নিবিষ্ট শান্ত আদলে হয়ে উঠেছে বিকশিত।
শান্তিনিকেতনে তিনি স্বয়ং সেখানকার ছাত্র শিক্ষককে স্বরচিত গান শেখাতেন। তাঁর এই সঙ্গীত প্রতিভা বিকাশক্ষেত্রে তিনি পূূূর্ণতর স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হন এবং তাঁর শিল্পী সত্তার একান্ত নিজস্ব ছাপটির বলিষ্ট আত্মপ্রকাশ ঘটান বিশ্বে। কোনও অনুকরণ, অনুসরণ ছিল না প্রথম দিকের সময়গুলিতে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের নিজত্ব সঙ্গীত সৃষ্টির উৎসধারা নিজস্ব স্রোতধারাভিমুখে এগুতে থাকে। এই নতুন ঢঙের অনবদ্য সুরধারাটি এতই স্বাতন্ত্র্য, প্রখর, উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় ছিল যে, একে একমাত্র ‘রাবীন্দ্রিক সুর’ নামেই চিহ্নিত ও অভিহিত করা চলে। প্রথমদিকে তাঁর সুর প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাগ বা লোকসঙ্গীতের প্রভাবান্বিত কোনও রূপরেখা ছাড়াই অনিন্দ্যরস সমৃদ্ধ এক নবধারার অতুলনীয় সুরবৈভব সৃষ্টি। সারাজীবনে রবীন্দ্রনাথ প্রায় আড়াই হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। প্রত্যেকটি গানে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, সুর, তাল একান্ত রবীন্দ্র প্রতিভার সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল পরিচায়ক।
পরবর্তীসময় রবীন্দ্রনাথ প্রভাবিত হয় ঠাকুরবাড়িতে জলসায় খ্যাতিনামা রাগসঙ্গীতের গায়ক–বাদক গনের রাগ সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। ঊনিশ শতকে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সারা বাংলার এক প্রধান সংস্কৃতি কেন্দ্ররূপে গণ্য হতো। দেশ বিদেশের বিদ্বান মনীষীরা এবং খ্যাতিনামা শিল্পীগণ প্রায়ই ঠাকুরবাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন। যেমন যদুভট্ট, বিষ্ণু চক্রবর্ত্তী, বরোদার সুপ্রসদ্ধি গায়ক মোল্লাবঙ প্রভৃতিগুণী শিল্পীর আনাগোনায় ঠাকুর পরিবার সঙ্গীতালয়ে পরিণত হয়। এদের অনেকেই ঠাকুর পরিবারের ছেলেমেয়েদের রাগ সঙ্গীত শেখাতেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা, অগ্রজ ভাইরা এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা শুধু যে সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন তা নয়, সঙ্গীতের বিশেষ চর্চা ও অনুশীলনে অগ্রজদের সাথে কিশোর রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণও নিশ্চিত ছিল। ঠাকুর পরিবারে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমাদর ছিল খুব বেশি। এর কারণ রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের এক প্রধান ও বিশিষ্ট উদ্যোক্তা। ঠাকুর পরিবারের সকলেই ‘ব্রহ্মধর্মের’ অনুসারী তাই ঠাকুর পরিবারের অনেকেই ব্রাহ্ম সমাজের উপসনার প্রয়োজনে ধর্মভাব রসপূর্ণ ধ্রুপদের ভঙ্গিতে ও তার আঙ্গিকের অনুসরণে বাংলায় ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ রচনা করতেন। রবীন্দ্রনাথও বহুসংখ্যক ধর্মীয় ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’ রচনা করেছিলেন। তাঁর ‘গীতাঞ্জলির’ প্রায় সব কবিতাই ভক্তিমূলক ও ধর্মীয় গান।
‘গীতাঞ্জলির’ ইংরেজী অনুবাদের জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ অর্জন করেছিলেন।
প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মসঙ্গীত রচনার সময় রাগসঙ্গীতে ধ্রুপদাঙ্গ সুরকে অবিকৃত রেখে নিজ রচিত বাংলা কাব্যাংশ সংযোজন করে নূতন গান রচনা করতেন। পরবর্তী জীবনে নানা রাগের মিশ্রণে আশ্চর্য্য সুন্দর সুরারোপ করে সুললিত গান সৃষ্টি করেছেন।
বাংলার লোকসঙ্গীতের প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ লোকসঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে সঙ্গীতে সুর সংযোজন করেছেন। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের পৈত্রিক জমিদারী। সে সুবাদে সুদীর্ঘকাল দিন যাপন করার সময়েই রবীন্দ্রনাথ বাংলার লোকসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের প্রতি ঘনিষ্টতা হওয়ার সুযোগ পান। লোকসঙ্গীতের সুর ও ভঙ্গিভাবে অভিভূত হয়ে তাঁর রচনাও সুরে প্রভাবটিকে নিপুণতার সাজাতে থাকেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে বাংলার লোকসঙ্গীতের হয় দুইটি ধারা প্রভাবিত ও উল্লেখিত তা হলো কীর্ত্তণ ও বাউলগান। শিলাইদহে বাসকালে রবীন্দ্রনাথ ঊনিশশতকের শেষভাগে বিখ্যাত বাউল সাধক লালন ফকিরের সাথেও সাক্ষাৎ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের সাথে যেদিন লালন ফকিরের ভাব বিনিময় হয় তা রসোচ্ছাসের মহামিলনক্ষেত্র রচিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যে হুবহু বাউলসুর অনুসরণ করেছিল তা নয় বাউলসুরের বিবেকগাথা প্রশান্তিপূর্ণ আনন্দময়তার ঐশ্বয্যটা তাঁর গানের সুরে বিশেষ ব্যক্তিত্বদান করেছে।
যৌবনের প্রথম ভাগেই তিনি ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ নামে বৈষ্ণব কবিদের ঢঙে ‘ব্রজবুলি’ ভাষার পদাবলী রচনা করেছিলেন। আসল পদাবলীর সাথে রবীন্দ্রনাথের পদাবলীর গায়নভঙ্গি সম্পূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
যেমন: ওহে জীবন বল্লভ। ওহে সাধন দুলর্ভ
সখি ভাবনা কাহারে বলে।
রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য জগতের বহুদেশে একাধিকবার গমন করেন। তাঁর সুর ও সঙ্গীত রচনায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সুর ও তাল প্রত্যক্ষ উপস্থিতি না ঘটলেও তিনি সেই সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধাবান ও প্রভাবান্বিত হন। রবীন্দ্রনাথের ভাগিনেয়ী সরলাদেবী উল্লেখ করেছেন, – ‘রবিমামা বিলেত থেকে ১৯ বছর বয়সে ফেরার পর তিনিই সঙ্গীতানুষ্ঠান ও পরিবেশনার নেতা হলেন, বাড়ীতে শেখা দেশী গান বাজনায় শুধু নয়, মেমদের কাছে শেখা যুরোপীয় সঙ্গীত চর্চায়ও আমাদের উৎসাহদাতা ছিলেন রবিমামা।’ রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে সরলা দেবী তাঁর কতগুলি গানে হার্মনীরীতির প্রয়োগ করেছিলেন। ইংরেজ পণ্ডিত আর্নল্ড বাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ যুবক বয়সেই জার্মানীর বিখ্যাত সুরকার বেঠোভেনের ‘অফবষধরফব’ গানটি গাইতেন। বিলেতে অবস্থান কালে পাশ্চাত্য সঙ্গীত শুধু পাশ্চাত্য গীতিনাট্যের প্রতিও তার আকৃষ্টতা বেড়ে যায়। দেশে ফিরে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি গীতিনাট্য রচনা করেন। প্রভাবান্বিত হলেও সঙ্গীত উপকরণ, হার্মনী, অর্কেস্ট্রা কোনও প্রভাবই পাশ্চাত্য রীতির লক্ষ্য করা চলে না।
বিখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে বার্লিন শহরে ১৯৩০ সালে এক সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি গভীর মমত্বের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন –
I am deeply moved by the western music. I feel that it is great, it is vast in it’s structure and grand in its composition, our own music touches me more deeply by its fundamental lyrical appeal. European music is epic in character. It has a broad background and is gothic in its structure.
আরও উল্লেখ করা চলে অঁষফ খধহম ঝুহবচ নামক এক বিখ্যাত পাশ্চাত্য গানের সুরের ছায়ায় রবীন্দ্রনাথ তার ‘পুরনো সেই দিনের কথা গানটি’ রচনা করেছিলেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব সমপর্কে শান্তি দেব ঘোষ ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে ‘আমাদের সঙ্গীতে অভাব ছিল মানবিক বৈচিত্রের। ইউরোপীয় সভ্যতার সংশ্রবে আমাদের মনোজগতের পরিবর্তন হল, আমরা রাগসঙ্গীতের একটিমাত্র স্থায়ীভাবের মধ্যে আবাদ্ধ থাকতে চাইলাম না। আমরা সংগীতের ভিতর দিয়ে ব্যক্তিগত ছোটোখাটো সুখ, দুঃখ ও নানা হৃদয়াবেগকে গানে ফোটাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। এইরূপ বিষয় বৈচিত্র্যে গুরুদেবের গান দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সংগীত রচনার ক্ষেত্রে তিনটি স্বতন্ত্র সংগীত ধারা লক্ষ্য করা যায়। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী এই ব্যাপারটিকে ‘ত্রিবেণী সঙ্গম’ নামে অভিহিত করেছেন। যেমন (ক) রাগ সঙ্গীত (খ) পাশ্চাত্য সঙ্গীত (গ) বাংলার সঙ্গীত (লোক)। উপরোক্ত তিনটি সঙ্গীত ধারা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন সুরের অনুসরণে পাঞ্জাব, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলের ভজন গানের সুরের আশ্রয়ে গান রচনা করেছিলেন।
আশি বছর জীবনে ষাট বছরেরও অধিক সময়কাল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সৃষ্টির এক উর্ধ্ব সাফল্য যুগ।
১৯২৪ সালে পূরবী কাব্যের বিখ্যাত ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতাটির শেষ ভাগের এক সংক্ষিপ্ত অংশের পরিবর্তন করেই রবীন্দ্রনাথ ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ এই গানটি তৈরি করেন। ১৯৪১ সালে মৃত্যুর মাত্র তিন মাস আগে রবীন্দ্রনাথের জীবনে সর্বশেষ রচিত এই গানটি কবি তাঁর একান্ত নিজেরই জন্মদিন উপলক্ষ্যে রচনা করে। সুর দিয়ে দেশবাসীর অন্তরে দাগ কেটে চির অমর স্থান করে গেছেন।
এই কাব্য প্রতিভা ও নিজত্ব সঙ্গীত প্রতিভার গুনে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ অর্জন করে বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, দেশপ্রেম ও ক্রমোন্নতি
আন্দোলনে জড়িত থেকেও শুধু কাব্য ও সঙ্গীত সৃষ্টি তাঁর পরিধি নয় তিনি কবি, নাট্যকার, সুরকার উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, প্রবন্ধকার, সাহিত্যিক, সঙ্গীতস্রষ্টা, সমাজসেবী, মানবদরদী ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ প্রতিভার শ্রদ্ধাসনে আসীন। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর টান ছিল অত্যধিক তাই রবীন্দ্রনাথ নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন– ‘জীবনের আশি বছর চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারিনে। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবুও বাকী থাকবে কিছু, জোড় করে বলা যায় না। যুগ বদলায়, কাল বদলায়, তার সঙ্গে সবকিছুই তো বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী ‘আমার গান’ এটা জোড় করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালির শোকে দুঃখে, সুখে – আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে।’
তাঁর সৃষ্টির প্রতি তার আত্মবিশ্বাসও গর্ব এত প্রকট এবং শুধু বাঙালি সমাজ না বিশ্ববাসীর কাছে তার সৃষ্ট সকল কর্ম গ্রহণীয় বরণীয় পূজনীয়। জীবনযাত্রার সকলধারার আবহ রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে নয়। তাঁর চেতনা ও কর্ম নিপুণতা এত বলিষ্ঠ বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে ধনী ও ঐশ্বর্যময় করার ‘রাজ’ রবীন্দ্রনাথ।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও সঙ্গীতশিল্পী।