অবশেষে শ্যামল সুন্দর বর্ষা এলো তার চিরমনোহর রূপে। সেদিন স্কুল মাঠের কদম গাছে কদম কলি দেখেছিলাম! সবুজ, কচি, আদুরে। কামিনী ফুলে সাদা হয়ে ওঠা গাছে তখনও ফোঁটা ফোঁটা জল, চাঁপা ফুলেরও ফোটার সময় আগতপ্রায়।
আকাশের অভিমান গলা জল চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পৃথিবীর মাটিতে। কাজলধোয়া জলের সেকি সৌন্দর্য! কী তার রূপ, কী তার সুরলহমা। যেনো কান পাতলে শোনা যায় বেহালার কান্না। মেঘের কাজলপরা আকাশের ভারী টলমল অবস্থা! সামান্যতেই যেনো গড়িয়ে পড়ে জল।
বুঝলাম, বর্ষা এলো! বৃষ্টির তাল আর বেহালার সুরে কালিদাসের চিনিয়ে দেয়া পথে বাঙালির চিরন্তন বিরহী বর্ষা আসে। বাঙালি পরম ভালোবাসায় বরণ করে নেয় প্রিয়তম বর্ষাকে। সেই চিনিয়ে দেয়া পথটুকু আলো করে যিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি রবি ঠাকুর। বলা যায়, বাঙালির মুখপাত্র। তিনি বলেছেন বলেই, নয়তো এই অভাগা মুখচোরা জাতি কবে বলতে পারতো তাদের মনের কথা!
সেই কবে কালিদাস পৃথিবীকে চিনিয়ে গেলেন বর্ষার হৃদয়গ্রাহী আকুলতা, বর্ষার ছন্দ, বর্ষার সুর, তার অস্তিত্ব। সেই থেকে বর্ষা আমাদের হলো। আর রবি ঠাকুর একান্তই আমাদের বর্ষাকে চিরচেনা ছন্দে, কথায়, নিত্যদিনের জীবনাচরণে অসাধারণ করে সেঁটে দিলেন। বাঙালির আবেগ বোঝাতে তাই আকাশের কৃষ্ণকালো মেঘ আর বিরহী বর্ষা উপমা হয়ে দাঁড়ায় সেই কালিদাসের সময় থেকে। রবীন্দ্রনাথের বর্ষাপ্রীতি নিয়ে নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। তিনি তাঁর প্রায় সমস্ত সৃষ্টিতেই বর্ষার প্রসঙ্গ এনেছেন বলা যায় স্বেচ্ছায়। তীব্র ভালোবাসাটুকু না থাকলে পরে প্রতি সৃষ্টিতেই বর্ষাকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জুড়ে দেয়া যায় না, তা সহজেই অনুমেয়।
সেই কবে ছড়ায় ছড়ায়, সুরে সুরে রবি ঠাকুর জায়গা করে নিলো আপামর জনগণের অন্তরে।
স্পষ্ট মনে পড়ে এই সেদিন মা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে পড়িয়েছিলেন, সুর করে করে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এলো বান’। মনে মনে বাদলা দিনের কত কল্পকথা তৈরী হতো নিমেষেই। তারপরের ইচ্ছেগুলো লাগামহীন।
বর্ষায় তখন প্রিয়জনের স্পর্শ মিশিয়ে নেশা লাগিয়ে দিলেন স্বয়ং কবিগুরু।
‘এমন দিনে তারে বলা যায় / এমন ঘনঘোর বরিষায়…’
‘সে কথা শুনিবে না কেহ আর, / নিভৃত নির্জন চারি ধার।/ দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী, / আকাশে জল ঝরে অনিবার-/ জগতে কেহ যেন নাহি আর-’ / তারপর কালিদাসকে চিনে নেবার পালা।
তিনিই চিনিয়ে গেলেন : ‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে / কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে / লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক’। বর্ষাকে তিনি তুলে ধরলেন ভিন্ন ভিন্ন রূপে। কখনো বর্ষাকে চেনালেন অতি আবেগে মাখামাখি হয়ে, কখনো রুদ্র প্রতাপে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সর্বনাশী প্রলয়রূপে। কখনো আহ্বান করলেন অতি মাঙ্গলিক আচারে। বর্ষামঙ্গলে বর্ষাকে তুলে ধরেছেন এভাবে– ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে / জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে / ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা/ শ্যামগম্ভীর সরসা।’ কৃষ্ণকলিতে বলেছেন– ‘এমনি ক‘রে শ্রাবণ – রজনীতে / হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।/ কালো? তা সে যতই কালো হোক, / দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ -/ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। কালো মেয়ের তথাকথিত দুঃখ ঘুচিয়ে দিলেন কলমের এক আঁচড়ে। শ্যামা মেয়ের দুঃখ গেলো ঘুচে। শ্যামা মেয়ে পেলো কৃষ্ণকলির তকমা। সেকি নয়নাভিরাম রূপে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলেন নগণ্য শ্যামা কন্যাকে। রবিঠাকুর ছাড়া এই স্পর্ধা কে দেখিয়েছে বাংলা সাহিত্যে!
বাদলদিনের গানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনবদ্য অবদান আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। বাংলা গান সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই, যেখানে তিনি পৌঁছাতে পারেননি।
‘বাদল–দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, / আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’ এই দুটো লাইন ছাড়া বর্ষাবরণ হয় না বাংলায়। তিনি এমনই কালজয়ী। কখনো প্রিয়াকে আহবান জানিয়েছেন অভিসারে– ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে।’ অথবা, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার /পরাণসখা বন্ধু হে আমার।’ তীব্র তাপদাহে বর্ষাকে আবাহন করতে গিয়ে বর্ষার স্তুতি করলেন, পৃথিবীতে সুশীতল শ্যামল বর্ষাকে নিমন্ত্রণ করলেন সুরে সুরে–
‘এসো শ্যামল সুন্দর, / আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।/ বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে।’
সুরের লহমায়, যন্ত্রের অনুষঙ্গে বর্ষাকে বরণ করে নিতে তাঁর অনবদ্য স্তুতিবাক্য– ‘আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা, / বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধুরা-’/ এসেছে বরষা, ওগো নব –অনুরাগিণী, ওগো প্রিয়সুখভাগিনী।’ এমনি অনেক গানে, কবিতায়, ছোটো গল্পে, উপন্যাসে, চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে অতি আপনার করে গড়ে তুলে দিয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত ভুবনে। সেখানে বর্ষা অনন্তকাল ধরে রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে রাখবে নিঃসন্দেহে। মহাকবি কালিদাস ছাড়া বর্ষার এত এত রূপবৈচিত্র্য আর অন্যকোনো কবি সাহিত্যিকের চোখে এতটা বিচিত্ররূপে ধরা দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার যে রূপ বাঙালি তথা পৃথিবীবাসীর চোখে ফুটিয়ে তুললেন, তা অনন্য, অতুলনীয়।
বর্ষাপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ এমনি এক বর্ষার দিনেই পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। এই এক মহীরুহের মৃত্যুতে পৃথিবী ভেসেছিলো বর্ষার কান্নায়। পৃথিবী ছাপিয়ে অশ্রুরাশি তীব্র আবেগে ফেটে পড়েছিলো সেদিন। তিনি এমন–ই! তিনি এভাবেই সমগ্র পৃথিবীর পরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন প্রিয়তমরূপে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী