রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের ১০৮তম দিবস ও আমাদের করণীয়

ফারহানা আকতার | মঙ্গলবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ২৫ বৈশাখে কলকাতার জোঁড়াসাকোর ঠাকুর বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মা ছিলেন সারদাসুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২টি, নাটক ৩৮টি, ছোটগল্প ৯৫টি, উপন্যাস ১৩টি, প্রবন্ধ ও গদ্য সংকলন-৩৬টি, গান-১৯১৫টি এবং তিনি ছবি এঁকেছিলেন প্রায় ২০০০টির মতো। আট বছর বয়স থেকে তিনি প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করেন তাঁর রচিত গান তিনটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা) জাতীয় সঙ্গীত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁর নোবেল বিজয়ের ১০৮ বছর পরেও আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর দর্শন, কর্ম ও স্মৃতির ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছি। সেটা কীভাবে? এবার সে প্রসঙ্গে আসা যাক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী, কর্ম ও স্মৃতি রক্ষার্থে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে কাজ হয়েছে বা হচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ। রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষার্থে রবীন্দ্র-গবেষণা ও রবীন্দ্র-দর্শনের মাধ্যমে পাঠদানের জন্য তাঁর নামে গড়ে উঠেছে ভারতের কলকাতায় দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশে মোট তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি ইনস্টিটিউট। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রধান দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, ১.বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ২. রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
১.বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় : এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ফাউন্ডার চেয়ারম্যান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রক্ষ্য ধর্ম চর্চার জন্য কবির বাবা শান্তিনিকেতনে যে আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের বেশ কয়েকটি বছর কাটিয়েছিলেন এবং সেখানেই ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তোলেন।
২. রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় : এটি অবস্থিত কবির জন্মস্থানে অর্থাৎ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথদের ঠাকুরবাড়ির স্মৃতি রক্ষার্থে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালের ৮ মে। এটি ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
এবারে ফিরে দেখা যাক, রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষা, রবীন্দ্র চর্চা ও গবেষণার জন্য বাংলাদেশে কোন কোন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে :
১. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, ২. ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ৩. রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ৪. রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়। মূলতঃ তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের তিনটি জায়গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারী ছিল, যথাক্রমে: ১. নওগাঁ জেলার পতিসরে, ২. কুষ্টিয়ার শিলাইদহে ৩. সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি রক্ষার্থে উপরোক্ত প্রতিটি স্থানে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র-দর্শনের আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
১. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় : বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবস্থিত এটি সম্পূর্ণরূপে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালের ৮ মে। ভারতের শান্তিনিকেতন ও বিশ্ব-ভারতীর আদলে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
২. ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনষ্টিটিউট (আন্তর্জাতিক রবীন্দ্র গবেষণা ইনষ্টিটিউট): নঁওগার পতিসরে রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের জমিদারী রক্ষার্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছর এখানে কাটিয়েছিলেন এবং এখানে কাব্য-চর্চার সময় তিনি এখানকার দরিদ্র মানুষকে দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি কৃষি ব্যাংক। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর নোবেল বিজয়ের পুরো অর্থই ব্যয় করেছিলেন এই কৃষি ব্যাংকের উন্নয়নের জন্য তা আজও আমাদের অনেকের অজানা যা সত্যিই বেদনাদায়ক। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের জীবনীতে এই অংশটুকু অবশ্যই যোগ করার প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী। পতিসরে রবীন্দ্র-স্মৃতি রক্ষার্থে ও রবীন্দ্র-দর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার আলো নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার মহান উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই প্রতিষ্ঠানটি এখানে সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে গড়ে করেন ইসরাফিল আলম, এম.পি (গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলদেশ সরকারের প্রাক্তন সংসদ সদস্য)। তিনিই এ প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান। এই প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের সময় তাকে নিরলসভাবে সার্বিক সহায়তা করেছেন বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র-স্মৃতি সংগ্রাহক ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী এম.মতিউর রহমাস। বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান (এ্যাক্িটং) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নানারকম জটিলতা সত্ত্বেও এই ইনস্টিটিউটটিকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেয়ার জন্য অথবা অন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় এনে পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচালনার জন্য যা যা থাকা প্রয়োজন তার প্রায় সবকিছুরই আয়োজন রয়েছে এখানে। রয়েছে রবীন্দ্র-যদুঘর (যা পুরোপুরি সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে), রয়েছে গবেষক ও স্টুডেন্টদের জন্য মনোরম ক্লাশরুম, হোস্টেল লাইব্রেরী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। রয়েছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল কোর্স ও প্রোগ্রামসমূহ। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সরকারিকরণের পর্যায়ে রয়েছে। নিন্মোক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ভিজিট করেছেন: ১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, চ্যান্সেলর, সকল বিশ্ববিদ্যালয়, ২.অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী, মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ভারত, ৩. জনাব আসাদুজ্জামান নূর, প্রাক্তন মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়, ৪. ড.আতিউর রহমান, বঙ্গবন্ধু চেয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রমুখ।
৩. রবীন্দ্র-মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় : কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি-বিজড়িত স্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাউন্ডার চেয়ারম্যান হাসানুল হক ইনু, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী ও কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য। এটি একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়।
৪.রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়: এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ঢাকার উত্তরায় ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যপক আনিসুজজামান-এর রবীন্দ্র শিক্ষা-ভাবনা ও আদর্শের আলোকে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়।
মূলত উপরে উল্লিখিত সবগুলো প্রতিষ্ঠানই বাঙালি কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রবীন্দ্র শিক্ষা ভাবনা, রবীন্দ্র দর্শন চর্চার মাধ্যমে তাদের কোর্স-কারিকুলামগুলো উন্নয়ন করেছে এবং প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র-ছাত্রী ও গবেষকদের জন্য রয়েছে অনার্স, মাস্টার্স, এম.ফিল ও পিএইচডি পর্যায়ের সকল বিষয়।
রবীন্দ্রচর্চা, স্মৃতি-রক্ষার এত আয়োজনের পরেও যখন জানতে পারলাম যে, শুধু লেখালেখিতেই নয়, মানুষ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন মহৎ মানব এবং তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। নওগাঁর পতিসরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য তাঁর নোবেল বিজয়ের সম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত করা, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং নিরলসভাবে তাদের জন্য কাজ করে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ের ১০৮তম দিবসে এসে আমি স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, আজ আমাদের উপলব্ধিতে এক গভীর শূ্‌ন্যতা, এ শূন্যতা কেবল সেদিনই পূরণ হবে যেদিন আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথের কর্ম, জীবনী ও নোবেল বিজয়ের ইতিহাসকে আরো শুদ্ধভাবে, পূর্ণাঙ্গভাবে ও স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারবো।
সকলকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে, বাজিবে হিয়া-মাঝে। বাতাস জল আকাশ আলো, সবারে কবে বাসিব ভালো? হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা, বসিবে নানা সাজে। নয়নদুটি মেলিলে কবে, পরান হবে খুশি? যে পথ দিয়া চলিয়া যাব, সবারে যাব তুষি। রয়েছ তুমি, এ কথা কবে, জীবন-মাঝে সহজ হবে? আপনি কবে তোমারি নাম, ধ্বনিবে সব কাজে’।

লেখক : পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, লেখক ও গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুগন্ধা ও ধলেশ্বরী নদীর বুকে কান্নার কলরোল
পরবর্তী নিবন্ধইস্তাম্বুলে বঙ্গবন্ধু: পাকিস্তানের নথি কমেডি