রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সংকট

বিদেশি জাহাজের ওয়েবার সনদপ্রাপ্তি নিয়ে জটিলতা

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের স্বার্থ রক্ষার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের রপ্তানি পণ্য পরিবহনে ভয়াবহ রকমের সংকট দেখা দিয়েছে। বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজের ওয়েবার সনদপ্রাপ্তি নিয়ে সংকট তীব্র হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে দুইটি বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজকে জরিমানা এবং বেশ কয়েকটি জাহাজকে শো’কজ করার পর পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে উঠেছে। বিদেশি জাহাজ মালিকদের পক্ষে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশন ইতোমধ্যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।

এদিকে দেশের রপ্তানিখাতের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হিসেবে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএও উদ্বেগ প্রকাশ করে আইনটি সংশোধনের সুপারিশ করেছে। বিজিএমইএ পণ্য রপ্তানিতে অহেতুক সময়ক্ষেপণ, ব্যয় বৃদ্ধি ও বিদেশি বায়ারদের অসন্তোষের কথা উল্লেখ করে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের কাছে জরুরি চিঠি দিয়েছে। বিজিএমইএর চিঠির প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর জরুরি সভা করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিদেশি জাহাজের ওয়েবার সনদের জন্য প্রতিদিনই মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টে ধর্না দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ (স্বার্থরক্ষা) আইন, ২০১৯ অনুসারে, জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনকৃত মোট পণ্যের ৫০ ভাগ দেশের পতাকাবাহী জাহাজে বহন বাধ্যতামূলক। তবে অভ্যন্তরীণ জাহাজে জায়গা না থাকা, বন্দরে বিদেশি জাহাজ না থাকা সাপেক্ষে ওয়েবার সনদ পাওয়ার পরই কেবল বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলো পণ্য বোঝাই করতে পারে।

এই আইন অনুযায়ী বিদেশি জাহাজে পণ্য লোড করার আগে জাহাজ মালিক বা প্রতিনিধি ওয়েবার সনদের জন্য নৌবাণিজ্য অধিদপ্তর অফিসে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে বন্দরে দেশীয় কোনো জাহাজ না থাকলে বা পরবর্তী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসবে না এমন নিশ্চয়তা পাওয়া পরই ওয়েবার সনদ ইস্যু করা হয়। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে এই ওয়েবার সনদ সংগ্রহ করতে বিদেশি জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধিদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। বন্দরে দেশীয় জাহাজ থাকায় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাহাজ পৌঁছাবে এমন নিশ্চয়তা থাকায় বিদেশি জাহাজের ওয়েবার সনদ ইস্যু করতে পারছে না নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তর। দিনের পর দিন ঘুরেও ওয়েবার সনদ না পাওয়া জাহাজগুলোর কোন কোনটি আইন লঙ্ঘন করে পণ্য বোঝাই করে জরিমানা এবং শোকজের কবলে পড়ছে। আবার কোন কোনটি পণ্য বোঝাই আংশিক কন্টেনার নিয়ে বন্দর ত্যাগ করছে। ইতোমধ্যে আইন না মানায় এমভি এসওএল প্রমিজ এবং এমভি এঙপ্রেস লোটসি নামের দুটি জাহাজকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি বিদেশি জাহাজকে। এসব জাহাজ বন্দর ত্যাগ করলেও শোকজ মাথায় নিয়ে শংকার মধ্যে রয়েছে।

কন্টেনার না নিয়ে জাহাজ চলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা জানান, পণ্য বোঝাই কন্টেনার সময়মতো সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে না পৌঁছালে মাদার ভেসেল মিস হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। মাদার ভেসেল মিস করলে ইউরোপআমেরিকার গন্তব্যে সঠিক সময়ে পণ্য পৌঁছানো অসম্ভব হয়ে উঠে। নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য না পেয়ে বিদেশি বায়ারেরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। তারা পণ্যের মূল্য পরিশোধে গড়িমসি করেন, ডিসকাউন্ট চেয়ে বসেন। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের একাধিক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী সংকটে পড়েছেন বলেও বিজিএমইএর একজন নেতা দৈনিক আজাদীকে জানান। তিনি বলেন, ওয়েবার সনদের বিষয়টি নিয়ে গার্মেন্টস রপ্তানিতে বেশ জটিলতা বিরাজ করছে।

বিজিএমইএ’র নেতারা দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম কলম্বো রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলো বেশ সংকটে পড়েছে। ওয়েবার সনদ না পাওয়ায় জাহাজগুলো নির্দিষ্ট পণ্য বোঝাই করতে পারে না। এতে দেশের রপ্তানিকারকদের সংকটের পাশাপাশি বিদেশি জাহাজ মালিকেরাও সংকটে পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে বিদেশি এসব জাহাজ মালিক চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন না করলে পুরো সেক্টরই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিজিএমইএ নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে চিঠি পাঠানোর কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৯০টি ফিডার ভ্যাসেল পণ্য পরিবহন করে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ রয়েছে মাত্র ৮টি। তিনি গার্মেন্টস পণ্যের ৯১ শতাংশই বিদেশি জাহাজ পরিবহন করে, দেশীয় জাহাজ করে মাত্র ৯ শতাংশ। মাত্র ৮টি জাহাজ দিয়ে রপ্তানি বাণিজ্য সামাল দেয়া কঠিন। দেশীয় বেসরকারি মালিকানাধীন জাহাজগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য যা করা হচ্ছে তাতে পুরো সেক্টরই হুমকির মুখে পড়ছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।

একাধিক শিপিং এজেন্টস পুরো সেক্টরে একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করে বলেন, কোন কোন জাহাজকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা কন্টেনার বোঝাই করার সময় নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। এতে ওই জাহাজটি কোনভাবেই অর্ডার নেয়া সব কন্টেনার বোঝাই করতে পারছে না। সম্প্রতি একটি জাহাজের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, ওই জাহাজটি ৫১০টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে কলম্বো যাওয়ার কথা ছিল। অথচ ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১১০ টিইইউএস কন্টেনার বোঝাই করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৪শ’ টিইইউএস পণ্য রেখেই জাহাজটি বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। বাকি পণ্যগুলো পরবর্তীতে পাঠাতে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের মাথার ঘাম পায়ে পড়েছে। পণ্যবোঝাই এসব কন্টেনার পরবর্তীতে ইউরোপ আমেরিকায় পাঠানোর ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। খরচ করতে হয় বাড়তি টাকা। তারা বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে সব পণ্য যায়, সেগুলো এখান থেকে সিঙ্গাপুর বা কলম্বো যায়। তারপর সেখান থেকে ইউরোপ, আমেরিকা বা যুক্তরাজ্যে যায় মাদার ভ্যাসেলে। সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে অপেক্ষমান মাদার ভ্যাসেল চলে গেলে এসব পণ্য নির্ধারিত সময়ে বাজারে পৌঁছে না। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের রপ্তানিকারকদের।

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ওয়েবার সনদ নিয়ে মারাত্মক সংকট হচ্ছে বলে উল্লেখ করে বলেন, দেশীয় জাহাজ যদি বেশি থাকতো তাহলে আমাদের কোন সমস্যা হতো না। অথচ আমাদের জাহাজ নেই। যে কটি জাহাজ আছে তা দিয়ে আমাদের রপ্তানিপণ্য ঠিকঠাকভাবে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। আমরা স্লট পাচ্ছি না। পুরো বিষয়টি চিঠি দিয়ে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি ব্যাপারটি খুবই জটিল হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে দেশের রপ্তানির স্বার্থে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাতা আর কাপড় শুকানোর কাজে আসে যে সেতু!
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের ১৬ আসনে তৃণমূল বিএনপি জোটের প্রার্থী ঘোষণা