এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) তাদের সামপ্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুল্কছাড় সুবিধা হারাবে। সে অবস্থায় বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ওপর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় শুল্কারোপ করা হলে দেশের রপ্তানির পরিমাণ সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। কানাডায় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ, ভারতে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, জাপানে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং চীনে ৭ শতাংশ হারে শুল্কারোপিত হতে পারে।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে জিএসপি+ সুবিধা না পায়, তাহলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত হতে পারে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে হলে দেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যের গন্তব্য বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার রপ্তানি পণ্যের বাজার সমপ্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, বাজার সমপ্রসারণের পাশাপাশি পণ্যের উৎপাদনও বহুমুখী করতে হবে। তিনি বলেন, রপ্তানি বাড়াতে পণ্যের বহুমুখীকরণের পাশাপাশি বাজার সমপ্রসারণ করতে হবে। এ সময় উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ মনোযোগ দেওয়ারও আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। অন্য এক অনুষ্ঠানে বৈদেশিক আয় বাড়াতে তৈরি পোশাকের মতো পাট ও চামড়াজাত পণ্য, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য এবং হস্তশিল্প সহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে একই গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের আরও নতুন পণ্য উৎপাদন এবং নতুন বাজার (রপ্তানির জন্য) অন্বেষণে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা বর্তমানে রপ্তানির জন্য কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভর করি। রপ্তানির জন্য একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভর করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তাঁর এক লেখায় বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে পণ্য রাপ্তানি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স। কিন্তু পণ্য রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স খাতের অবস্থা বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। এ দুই খাতের প্রবৃদ্ধি মোটেও সন্তোষজনক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস অর্থাৎ জুলাই–মার্চ সময়ে পণ্য রপ্তানি খাতে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আর জনশক্তি রপ্তানি খাতে জুলাই–মার্চ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। জনশক্তি রপ্তানি খাতে আহরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ সামপ্রতিক সময়ে অনেকটাই কমে গেছে। মার্চে রেমিট্যান্স আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক। এ সময় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় মাইনাস ১ দশমিক ২৭ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত পণ্য রপ্তানি এবং জনশক্তি রপ্তানি খাতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত না হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ও রিজার্ভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। এরপরেই রয়েছে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য, ওষুধ, বাইসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বেশিরভাগটাই নির্ভর করে বড় যে দুটি বাজার রয়েছে, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা, সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরে। সাম্প্রতিক যে বিশ্ব মন্দার যে প্রভাব ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে তা হয়তো আরও গভীর হবে। বাংলাদেশের সরকার রপ্তানি আয় আরও বাড়াতে চায়। সে জন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখনো রপ্তানি আয়ের ওপরে সরকার প্রণোদনা দিয়ে থাকে। কিন্তু রপ্তানি কতটা হবে, তা নির্ভর করে অন্য দেশগুলোয় পণ্যের কতটা চাহিদা রয়েছে তার ওপরে। কিন্তু বিশ্ব মন্দা, ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার মতো বিষয় তো বাংলাদেশের হাতে নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে রপ্তানি ঝুড়িতে শুধু একটি পণ্যের আধিপত্য। একটি পণ্য দিয়ে বাজার সম্প্রসারণ করা বেশ কঠিন। চীন, ভারতসহ প্রতিশ্রুতিশীল বাজারে প্রবেশের জন্য এসব দেশের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনে উদ্যোগ নিতে হবে।