প্রভু জগন্নাথ হচ্ছেন জগতের নাথ, প্রভু বা স্বামী। তিনি জগতের প্রতিপালক ও রক্ষাকর্তা। কমলনয়ন জগন্নাথ দেবের কৃপারাশি অন্তহীন। লীলাময় তিনি। যুগ প্রয়োজনে ভক্তের ইচ্ছা পূর্ণ করতে তিনি বিভিন্ন লীলাবিলাসে অবতীর্ণ হন। তেমনতর এক চমৎকার লীলায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি মালব্যদেশের অবন্তী নগরের রাজা মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের কাতর প্রার্থনায়। মহান্ ভগবদ্-ভক্ত ছিলেন ঐ রাজা। ভগবানের অদর্শনে তিনি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। হঠাৎ ভগবান নীলমাধবের খোঁজ পেয়ে তিনি রাজপুরোহিত বিদ্যাপতিসহ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের প্রেরণ করলেন নীলমাধবের সন্ধানে। সকলে নিরাশ হয়ে একে একে ফিরে এলেও রাজপুরোহিত বিদ্যাপতি বহু ক্লেশ স্বীকার করে ভগবান নীলমাধবের সন্ধান নিয়ে তবেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে ফিরে আসেন। তাঁর কাছ থেকে খবর পেয়ে আর কাল বিলম্ব না করে মহারাজ রাজপরিকর ও সৈন্যসামন্তসহ অভিযান করলেন নীলমাধবের সন্ধানে। কিন্তু যথাস্থানে উপনীত হবার আগেই নীলমাধব সেই মন্দির হতে অন্তর্হিত হন। তাই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবের দর্শন পেলেন না। ভগবানের কাছে এসেও নীলমাধবের দর্শন না পেয়ে মহারাজ দুঃখে দেহত্যাগ করার মনস্থির করলেন। তখন দৈববাণীর মাধ্যমে ভগবান নীলমাধব মহারাজকে বললেন, “মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন! তুমি শোক নিবারণ করো। তুমি নীলমাধবরূপে আমার দর্শন পাবে না। তুমি সমুদ্র তীরে একটি বড় মন্দির নির্মাণ করো, তথায় দারুব্রহ্মরূপে আমার দর্শন পাবে।
শ্রীভগবানের নির্দেশমতো মহারাজ দারুব্রহ্মকে সমুদ্রের চক্রতীর্থ নামক স্থান থেকে উদ্ধার করে শ্রীমন্দিরে এনে স্থাপন করলেন। কিন্তু কেউ দারুব্রহ্ম থেকে শ্রীমূর্তি নির্মাণ করতে পারলেন না। তখন ভগবান স্বয়ং অনন্ত মহারাণী নামক এক সূত্রধররূপে আবির্ভ্থূত হয়ে শ্রীবিগ্রহ রূপদানে রাজি হলেন একটি শর্তে যে, বিগ্রহ নির্মাণকালে একুশ দিনের মধ্যে কোনো ব্যক্তি শ্রীমন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি কেউ অমান্য করে প্রবেশ করে তবে শ্রীবিগ্রহ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকবে। মহারাজ সূত্রধরের কথামতো রাজি হওয়ায় বিগ্রহনির্মাণের কাজ শুরু হলো। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর কোনো রকমের শব্দ না পেয়ে মহারাজের মনে সন্দেহ হলো। অগত্যা মন্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও রাণীর কথামতো তিনি জোর করে মন্দিরের দরজা খুলে ফেললেন এবং শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রার বিগ্রহত্রয় অসম্পূর্ণ অবস্থায় দর্শন করলেন। কিন্তু সেই সূত্রধর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। যিনি স্বয়ং প্রকাশিত, তাঁকে আবার প্রকাশিত করবে মরজগতের কোন সূত্রধর! তা কী সম্ভব! প্রকৃতপক্ষে শ্রীবিগ্রহ হচ্ছে সচ্চিদানন্দময় এবং স্বপ্রকাশিত। তবুও লীলাবিলাসে এমন রূপ পরিগ্রহ করলেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন দেখলেন বিগ্রহ তিনটির হাতের আঙুল নেই এবং পায়ের পাতাও নেই। অসম্পূর্ণ শ্রীদেহ নিয়ে মহারাজার সামনে প্রকটিত হলেন। নিজেকে তিনি মহা অপরাধী মনে করলেন এবং ধিক্কার দিতে লাগলেন, কেন নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। যখন এমন দুঃখে ও শোকে জীবন ত্যাগের সংকল্প করলেন তখন আবার দৈববাণী হলো, “হে আমার ভক্তশ্রেষ্ঠ মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন! তুমি তোমার সংকল্প পরিত্যাগ করো। আমি পুরুষোত্তমক্ষেত্র জগন্নাথপুরীতে নিত্যকাল এই প্রকার অর্চা-বিগ্রহরূপে বিরাজিত আছি। এটি আমার নিত্য, অব্যয় ও শাশ্বত চিন্ময় রূপ। এই জগন্নাথ রূপেই আমি সমগ্র জগৎকে প্রতিপালন করে থাকি। তুমি আমার এই রূপেরই অভিষেক ক্রিয়া ও নিত্য পূজাদির সুবন্দোবস্ত করো। আমার হস্ত-পাদাদি না থাকার কারণ হচ্ছে যে, “আমি আমার অপ্রাকৃত হস্তের দ্বারা ভক্তের প্রীতি ও শ্রদ্ধাযুক্ত অর্ঘ্য গ্রহণ করে থাকি।” প্রকৃতপক্ষে শ্রীভগবানের ইন্দ্রিয়গুলো প্রাকৃত নয়, তাই এই প্রাকৃত জগতে কোনো কিছুই তাঁর প্রয়োজন হয় না।
ভগবানের প্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কোনো কার্য নেই, কেননা তাঁর প্রাকৃত দেহ ও প্রাকৃত ইন্দ্রিয় নেই। কোনো বস্তুই তাঁর সমান বা তাঁর থেকে অধিক রূপে দৃষ্ট হয় না। তিনি অচিন্ত্য শক্তির আধার। তাঁর সেই অচিন্ত্য শক্তির নাম পরাশক্তি। এক হয়েও সেই স্বাভাবিকী পরাশক্তি জ্ঞান (সৎ), বল (সন্ধিনী) ও ক্রিয়া (হ্লাদিনী) ভেদে ত্রিবিধা। বিশ্ববিভু শ্রীজগন্নাথের অসম্পূর্ণ হস্ত-পদযুক্ত এই অপ্রাকৃত রূপের নেপথ্যে আরও একটি সুগভীর ও রসময় তাৎপর্য নিহিত আছে এবং তা হচ্ছে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দ্বাপর লীলায় ১৬১০৮ জন মহিষীদের মধ্যে রুক্ষ্মিনী, সত্যভামা, জাম্বুবতী আদি মহিষীগণ প্রধান ছিলেন। এই মহিষীরা সর্বতোভাবে শ্রীকৃষ্ণের সুখাবধান করে থাকেন। এরপরও তাঁরা শ্রীকৃষ্ণের মন কিছুতেই পাচ্ছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণের মনোবেদনার অন্তর্নিহিত কারণ কি তা জানার জন্য একদিন দ্বারকায় মহিষীরা শ্রীমতী রোহিণী দেবীকে অনুরোধ করেন। তখন রোহিনী দেবী বললেন, “আমি জানি এর অন্তর্নিহিত কারণ। তোমরা শোন, আমি বলছি। তবে দরজায় একজনকে পাহারা দিতে হবে যাতে কৃষ্ণ-বলরাম এসে না শুনতে পায়।” তখন শ্রীকৃষ্ণের বোন সুভদ্রা দেবীকে দ্বার পাহারায় নিযুক্ত করা হলো।
তখন রোহিণী দেবী কৃষ্ণ মহিষীদের কাছে বৃন্দাবনের ব্রজগোপীদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার অপূর্ব প্রেমময় লীলা বিলাসগুলো বর্ণনা করছিলেন। এভাবে শ্রীকৃষ্ণ ও ব্রজাঙ্গনাদের মধ্যে গভীর প্রণয় এবং রসময় লীলার কথা যখন একে একে রোহিনী দেবী বলছিলেন, তখন তা শুনতে শুনতে দ্বারে পাহারারত শ্রীমতী সুভদ্রাদেবীর শ্রীঅঙ্গে অষ্টসাত্ত্বিক বিকার প্রকাশিত হলো এবং তাঁর হস্ত-পদাদিসহ দেহের ইন্দ্রিয়সমূহ দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে তিনি কূর্মাকৃতি প্রাপ্ত হলেন। এদিকে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় শ্রীকৃষ্ণলীলা মাধুরী শ্রবণ করে কোন ফাঁকে বোন সুভদ্রা দেবীর পাশে এসে লুকিয়ে থেকে রোহিণীদেবীর শ্রীমুখ থেকে বৃন্দাবনের দিব্য লীলাগুলো শ্রবণ করছিলেন মহিষীরা। আর সেখানে এসে উপস্থিত হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। সুভদ্রা দেবী শ্রীকৃষ্ণ-বলরামকে নজরে রাখতে পারেনি। কেননা তিনি নিজেই ইতোমধ্যে দিব্যভাব কূর্মদশা প্রাপ্ত হয়ে সমাধিমগ্ন হয়ে আছেন। বাহ্যজ্ঞান তিনি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছেন শ্রীকৃষ্ণ কথা শ্রবণে। বৃন্দাবনের শ্রেষ্ঠ ভক্ত গোপাঙ্গনাদের সঙ্গে তাঁদের মাধুর্য লীলাবিলাস শ্রবণ করার ফলে শ্রীকৃষ্ণ-বলাম-এর শ্রীঅঙ্গেও অষ্টসাত্ত্বিক বিকার উদয় হলো এবং তাঁদের দিব্য হস্ত-পাদ তাঁদেরই শ্রীঅঙ্গে প্রবিষ্ট হয়ে তাঁরা দু’জনে কূর্মভাব প্রাপ্ত হলেন। মহাবিকারগ্রস্ত অবস্থায় বোন সুভদ্রা দেবীর দু’পাশে দু’জন দাঁড়িয়ে গেলেন।
সর্বডানে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র। মাঝখানে দেবী সুভদ্রা এবং বামে শ্রীবলরাম-বিকারগ্রস্ত হস্ত-পদহীন শ্রীদেহ নিয়ে জগন্নাথ লীলায় অবতীর্ণ হলেন। শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম ও সুভদ্রা দেবীর অষ্টসাত্ত্বিক মহাবিকার সমন্বিত কূর্মভাব নিয়েই শ্রীশ্রীজগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রাদেবী রূপে পুরুষোত্তমক্ষেত্র নীলাচলে ইন্দ্রদ্যুম্ন মহারাজার প্রেম-ভক্তিতে প্রবুদ্ধ হয়ে দারুব্রহ্মরূপে প্রকটিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং গোলোকপতি অখিল রসামৃত সিন্ধু শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন, “আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শ্রীবলদেব ও দেবী সুভদ্রাকে সহ আমাকে রথে আরোহণ করিয়ে ‘রথযাত্রা উৎসব’-এর আয়োজন করবে এবং গুণ্ডিচা মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যাবে।” তখন থেকেই রথযাত্রা উৎসব শুরু। এই রথকে নবম দিনে উল্টো দিকে টেনে শ্রীমন্দিরে আবার নিয়ে আসা হয় যাকে ‘উল্টোরথ’ বলা হয়। রথযাত্রার প্রায় পনের দিন পূর্বে জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমাতে শ্রীজগন্নাথ দেবের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে মহাস্নানযাত্রা মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বিবিধ সুগন্ধি জলসহ চন্দন দিয়ে তাঁর মহাস্নান শেষে তিনি শয্যাশায়ী হন এবং পনের দিন মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে। পনের দিন পর পরমেশ্বর জগন্নাথদেবের নতুন পোশাক ও অলংকারে ভূষিত হন। তারপর শ্রীজগন্নাথ গুণ্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন ব্রজধামের মাধুর্যরস আস্বাদনের অভিলাষী হয়ে। সেই সঙ্গে তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আপনার সকলের প্রতি তাঁর অহেতুকী কৃপাবৃষ্টি বর্ষণ করেন। নীলাচলপতি শ্রীভগবানের এ এক অপ্রাকৃত মাধুর্য লীলাবিলাস। রথে চড়ে আসেন তিনি ভক্তসঙ্গ অভিলাষে। সমগ্র সনাতনী সমাজের জন্য এটি একটি মধুময় সংবাদ বটে। যেই ভগবানকে পাবার জন্য আমরা মন্দিরে যাই, সেই ভগবান আজ ভক্ত দর্শনে এসেছেন শ্রীমন্দির থেকে বেরিয়ে রথে চড়ে। অযাচিত করুণা বিতরণে এসেছেন তিনি এভাবে। অসীম যিনি, তিনিই সসীমের পানে যাত্রা করেন রথযাত্রায়। শাস্ত্র বলেন- রথোপরি বামনরূপী শ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করলে তার আর পুনর্জন্ম হয় না। রথযাত্রা উৎসব মহামিলনের উৎসব। জগতের আনন্দযজ্ঞে মিলিত হতে আসেন রথযাত্রায় ভগবান ।
রথযাত্রার মহান শিক্ষা হলো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই বিশ্বপিতার সন্তান হিসেবে তাঁরই শ্রীচরণ সেবার অধিকারী। তবে বিশুদ্ধ মন আর নির্মল হৃদয় না হলে কিন্তু শ্রীভগবানের অপ্রাকৃত এই লীলাবিলাস থেকে আমরা হবো বঞ্চিত। ভক্ত আর ভগবানের মহামিলন লীলাই হচ্ছে রথযাত্রা উৎসবের মূল তাৎপর্য। ভক্ত ছাড়া যেমন ভগবান থাকতে পারেন না, তেমনি ভগবান ছাড়াও ভক্ত থাকতে পারেন না। এই লীলাতে তা প্রকাশিত হয়েছে। রথযাত্রার রথোপরি, শ্রীজগন্নাথ হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান, মাঝখানের সুভদ্রা দেবী স্বয়ং ভক্তিদেবী বামে বলরাম ভক্ত স্বরূপ। ভগবান-ভক্তি-ভক্ত এ তিন স্বরূপ নিয়েই রথযাত্রায় শ্রীভগবানের আগমন ভক্তসমাজে।
লেখক : ধর্মতত্ত্ববিদ ও কলেজ শিক্ষক।