সমুদ্রের মাঝে জাহাজ দেখতে কী সুন্দরই না লাগে! আর শুধু সমুদ্রে কেন? নদীর মাঝ দিয়েও যখন রাজকীয়ভাবে জাহাজ এগিয়ে চলে বন্দরের দিকে, আলাদা একটা রোমাঞ্চকর শিহরণ অনুভব হয়। আপনারা যারা পতেঙ্গায় গিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে এব্যাপারে একমত হবেন। আচ্ছা, জাহাজ দেখার সময়ে একটা জিনিস কি কখনো খেয়াল করেছেন? জাহাজের রঙ? এটা তো আমরা সকলেই বুঝি যে, প্রতিকূল পরিবেশ থেকে রক্ষার জন্যে পেইন্ট করা হয়। সেটা তো সবকিছুর জন্যই প্রযোজ্য- গাড়ি, বাড়ি,রিক্সা-ঠেলাগাড়ি,ফ্রিজ,দরজা-জানালা-দেওয়াল, বাস-লঞ্চ, কলকব্জা-যন্ত্রপাতি ইত্যাদি দুনিয়ার প্রায় তাবৎ জিনিসেই পেইন্ট দরকার। খুবই ভালো কথা- সবকিছুর মতোই তাহলে জাহাজও পেইন্ট করা হয়। কিন্তু কখনো কি পানির তলার দিকে জাহাজের খোলের রঙ খেয়াল করে দেখেছেন? সেটা কী শুধুই সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে? নাকি আরো কিছু আছে সেখানে? আর একটু খোলাসা করে বলি, অধিকাংশ জাহাজেই পানির তলার বডিতে লাল রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। কৌতুকছলে বলতে পারি, বিশ্বের প্রায় প্রতিটা ভাষাতেই জাহাজকে স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে উল্লেখ করা হয়; এবং মহিলারা লাল লিপস্টিক পছন্দ করেন বলেই জাহাজেও লাল রঙ বেশি মাখা হয়। আসলে কিন্তু সেটা না; এবং এর একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ব্য্যখ্যা রয়েছে। চলুন আজ সেইটা নিয়েই আলোচনা করি।
প্রথমেই জাহাজ যে কতরকমের প্রতিকূল পরিবেশে যাচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করি। পানি নিজেই একটা ক্ষতিকারক জিনিস। জাহাজ কখনো ভাসছে নদীর মিঠাপানির উপরে, আবার কখনো সমুদ্রে চরম ক্ষয়কারক লোনাপানির উপরে। শুধু লোনাপানি-মিঠাপানি চিন্তা করলেই চলবে না। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রার তারতম্য আছে, ভাসমান বরফ বা অন্যান্য অনেক আবর্জনা রয়েছে, টাগবোটের গোঁত্তা রয়েছে, জেটির সঙ্গে ঠোকাঠুকি- সবকিছুই জাহাজের বডি (২)-এর উপর দিয়ে যায়। তবে জাহাজের বডির জন্যে বেশী ক্ষতিকারক হলো, সামুদ্রিক কিছু প্রাণী- গুগলি, শামুক, ঝিনুক, বার্নাকেল, পোকা, সামুদ্রিক আগাছা ইত্যাদি হাজার রকমের জীব। এগুলো লাখে লাখে জাহাজের খোলের সঙ্গে লেগে থাকে (marine growth )। সমুদ্রপাড়ের যে কোনো জেটির পায়ার সিমেন্টের বা লোহার পিলারগুলোর পানি বরাবর খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন আমি কোন জিনিসিগুলোর কথা বলছি। সেগুলো একবার জাহাজের খোলের সাথে লেগে গেলে তাদের আর সহজে ছাড়ানো যায় না। এটাকে ফাউলিং (fouling ) বলে। আদিকালে, কাঠের জাহাজেও একইভাবে লেগে যেতো। এরকম লাখে লাখে শামুক-গুগ্লী-বার্নাকেল গায়ে লেগে থাকার ফলে, জাহাজের ওজনও বাড়ে আর গতিও অনেক কমে যায়। আমরা বলি ফৎধম- পিছুটান। একটা মসৃণ খোলের জাহাজ যেভাবে পানি কেটে এগুবে, সেই তুলনায় লাখে-লাখে বার্নাকল-ঝিনুকওয়ালা জাহাজের গতি অনেক কমে যাবে। তার থেকেও ক্ষতিকর হলো – সেগুলো কাঠ খেয়ে ফুটা করে বা পঁচন ধরিয়ে দিতো। আপনারা খেয়াল করেছেন দেশী নৌকা-সাম্পানে আলকাতরা মাখায়- কারণ একই। কাঠ পঁচে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা, আর নৌকার গায়ে যাতে সেই পরজীবীগুলো না লাগতে পারে। এগুলো ঠেকাতে, আদিযুগে বড় বড় সামুদ্রিক কাঠের জাহাজে তামার পাত ব্যবহার করতো। তামা biocide (জীবধ্বংসী) হিসাবে কাজ করে, এবং সেজন্যে পরজীবীগুলো জাহাজের খোলে কম আটকাতো। আধুনিক যুগে এসে, তামার পাতের পরিবর্তে তামা বা copper-based পেইন্ট ব্যবহার শুরু হলো। তামার অক্সাইড (কিউপ্রিক অক্সাইড) লাল রঙের, তাই পেইন্টও ছিলো লাল রঙের। সেজন্যই প্রায় অধিকাংশ জাহাজের পানির তলার খোলের রঙ দেখবেন লাল রঙের। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক সিনথেটিক মেরিন এন্টি-ফাউলিং পেইন্ট যে কোনো রঙেরই পাওয়া যায়। তাই লাল ছাড়া অন্য রঙেও দেখতে পাবেন আজকাল; যদিও অনেক জাহাজই ট্রেডিশান বজায় রাখতে এখনও লাল রঙই করে।
তবে ভালোমত খেয়াল করলে দেখবেন যে, যতই রং-লিপস্টিক মাখা হোক না কেন, সেই শামুক-গুগলি-বার্নাকেল এগুলো থেকে রেহাই নাই। আগেকার যুগের তুলনায় অনেক কম হলেও, বেশ ভালো পরিমাণেই জাহাজের গায়ে লেগে থাকে। সেগুলোকে ঘষে ঘষে তুলতে হয়। তবে সেখানেও বিধিনিষেধ আছে। যখন-তখন যে কোন পোর্টে বা এঙ্কোরেজে বসে সেগুলোকে ঘষে তুলে তাদের সেখানের পানিতে ফেলা যাবে না। ফেললে, ভয়ানক ব্যাপার হয়ে যাবে, বড়সড় পেনাল্টি গুনতে হতে পারে। কেউই চায় না যে, তাদের পানিতে বিজাতীয় এবং ক্ষতিকর সেই শামুক-ঝিনুকের খোলগুলো পড়ুক- একটা বড়সড় পরিবেশ-দূষণ মামলায় ফেঁসে যাবেন। ড্রাইডকে জাহাজ উঠলে, সেখানে এগুলোকে ভালোমত পরিষ্কার করে নিয়ে নতুন পেইন্ট লাগানো হয়।
আজকালকার যুগের জাহাজ তৈরিই হয় লোহা (iron ) আর ইস্পাত (steel ) দিয়ে। সাধারণ আবহাওয়াতেই লোহায় মরিচা ধরে যায়। পানির তলায় থাকলে তো ধরবেই। আর সেই পানি যদি সমুদ্রের লোনা পানি হয়, তাহলে তো কথাই নাই। এছাড়াও জাহাজের গতি, বাতাসের অক্সিজেন, পানির মধ্যের ক্ষয়কারক পদার্থ সবকিছুই লোহা-ইস্পাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। কিন্তু জাহাজের যেই অংশ পানির উপরে থাকে, সেখানের কী অবস্থা? ঝড়-বৃষ্টি, লোনাপানির বাতাস এবং ঢেউয়ের ঝাপটা কমবেশী সবই সহ্য করতে হয়। সেগুলোতে সেই মেরিন-গ্রোথ না হলেও, মরিচা তো পড়বেই। সুতরাং, সেখানেও খুবই যত্ন নিয়ে rust-preventive রঙ লাগানো হয়। কোথায়ও রঙ উঠে গেলে, নতুন করে রঙ লাগানোর কায়দা অনেক। হুট করে রঙ লাগিয়ে দিলেই হবে না, দুদিনেই আবার চলটা উঠে চলে আসবে। প্রথমে, ভালোমত জায়গাটাকে ঘষে নিতে হবে chipping করে; তারপরে প্রাইমার পেইন্ট লাগিয়ে শুকাতে হবে। এরপরে, প্রাইমারের উপরে ফাইনাল পেইন্টের কোটিং দিতে হবে। জাহাজে চিপিং-পেইন্টিং একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ধরাবাঁধা কাজ। এই কাজের জন্যে কতধরনের যে যন্ত্রপাতি আছে! তবে চিপিং করা মানেই, আওয়াজের চোটে কানে ঝালাপালা ধরে যাওয়া।
পানির তলায় মেরিন-গ্রোথ থেকে বাঁচতে তামাসহ পেইন্ট দিলাম, উপরে মরিচা থেকে বাঁচাতে দিলাম রাস্ট-প্রিভেন্টিভ পেইন্ট। কিন্তু আধুনিক যুগে আরও একটা নতুন টেকনিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমরা যে ব্যাটারি ব্যবহার করি, সেই ব্যাটারির থিওরিকে কাজে লাগিয়েই লোহা/ইস্পাতের জাহাজের বডি বা যঁষষ-কে রক্ষা করা হয়। দুই ভিন্ন ধরনের ধাতু যদি একটা ইলেক্ট্রোলাইটের মাধ্যমে থাকে তাহলে একটা ভোল্টেজের তারতম্য তৈরি হবে, যার ফলে কারেন্ট চলতে পারে এবং একটা ধাতু ক্ষয় হয়ে যাবে। আহ্ হা! ভালো কথা তো। তাহলে, এটাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়? সমুদ্রের লোনা পানি তো ইলেক্ট্রোলাইট হিসাবে কাজ করতে পারে। আর জাহাজের বডি তো রয়েছেই, যেটাকে আমরা রক্ষা করতে চাইছি। তাহলে, সেখানে সেই পানির মধ্যে অন্য একটা ধাতু রেখে দিই, যেটা সেই ব্যাটারি-থিওরি অনুযায়ী নিজে ক্ষয় হবে, কিন্তু জাহাজকে রক্ষা করবে। ইউরেকা!
কেমিস্ট্রি যারা পড়েছেন তারা হয়তো গ্যাল্ভানিক সিরিজ এবং নোবেল মেটাল সম্পর্কে জানেন। এই সিরিজে লোহা বা ইস্পাতের চাইতে ইলেক্ট্রিক্যালি বেশি এক্টিভ ধাতু (জিঙ্ক, এলুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম) জাহাজের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হয় (ংধপৎরভরপরধষ ধহড়ফব)। থান ইটের সাইজের জিঙ্কের ব্লক চিন্তা করুন। সেরকম বেশ অনেকগুলো জাহাজের বডিতে পানির তলায় লাগানো থাকে। সমুদ্রের লোনা পানিতে (ইলেক্ট্রোলাইটের মাঝে), সেই জিঙ্ক গ্যাল্ভানিক সেল-এর প্রক্রিয়ায় নিজে ক্ষয় হতে থাকবে, কিন্তু জাহাজের বডিকে প্রটেক্ট করবে। ক্ষয় হতে হতে শেষ হয়ে গেলে, আবার ড্রাইডকিং-এর সময়ে নতুন লাগিয়ে নিতে হবে। কখনো যদি ড্রাইডকে কোনো জাহাজ দেখার সুযোগ পান, তাহলে এগুলো দেখে নিতে ভুলবেন না। প্রপেলারের আশেপাশে বেশী থাকে, কারণ, প্রপেলারের ঘূর্ণনে, অক্সিজেন এবং ক্যাভিটেশান ইত্যাদি কারণে মরিচা পড়া দ্রূত হয়।
আজকাল, ICCP (Impressed Current Cathodic Protection ) নামে আরো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেক্ট্রিক কারেন্ট সাপ্লাই দেওয়া হয় সেই এনোডে, যার ফলে, তারা আর ক্ষয়ও হয় না। সমুদ্রের পানি যতটুকু কারেন্ট তৈরি করতে সক্ষম সেটা মেপে নিয়ে, একটা কন্ট্রোল-প্যানেল থেকে তার বিপরীত ডি.সি. কারেন্ট সাপ্লাই করলেই হলো। জাহাজের বডিও বাঁচলো, এনোডও বাঁচলো। সেক্ষেত্রে প্লাটিনাম বা টাইটানিয়াম ব্যবহার করে।
আচ্ছা, আমরা জানলাম লাল রঙ পানির তলার খোলে থাকে, আর উপরে থাকে rust-preventive পেইন্ট। কিন্তু, তাহলে তো আর একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে হয়- দুই রঙের মাঝের বিভাজনরেখা। সেইটা কী? কেন? কোথায়? কীভাবে? পরের সংখ্যায় এ ব্যাপারে লিখবো। কারো যদি কোনো বিষয়ে কোনো কৌতূহল থাকে, তাহলে আমাকে refayet@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২