মানুষের চিরায়ত স্বভাবমতে তারা সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ায় রাজনীতির ময়দানে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। সেই ক্ষেত্রে মতের অধিকার ও ঈর্ষা প্রবলভাবে মানুষকে গুজব ছড়ানোর জন্য প্রলুব্ধ করে। প্রত্যেক ধর্মেই গুজব বা মিথ্যাচারকে অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে মিথ্যাকে সব গুনাহর মা বলা হয়েছে। গুজবের অন্যতম প্রতিক্রিয়া হলো ফিতনা। যা হত্যাকাণ্ডের চেয়েও জঘন্য অপরাধ।
আমাদের দেশের রাজনীতিতে গুজব যে কত বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে এবং তা হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বড় নৃশংস ও জঘন্যতম তার প্রমাণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এশিয়ার লৌহমানব সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার ও অন্যান্য আত্মীয়–স্বজনদের সাথে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এ কথা অনেকে বলে থাকেন খুনের পিছনে রাজনৈতিক অসন্তোষ এবং সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কিছু জুনিয়র অফিসারের ব্যক্তিগত রাগ–বিরাগ এবং ক্রোধ এই ঘটনার জন্য দায়ী। কেউ কেউ আবার বিদেশী মদদদাতা চক্রান্তকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের দোষ দেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের নেপথ্যের কাহিনি আমাদের জাতীয় জীবনে সে রাতে নিহতদের রক্ত কর্তৃক সৃষ্ট বিপর্যয় নিয়ে খুব একটা ঘাটাঘাটি করতে চাই না। কারণ কেঁচো খুড়তে সাপ বের হয়ে আসে যদি? নেত্রী কিছু দিন আগে একটি সভায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর আওয়ামীলীগের নেতা–কর্মীরা কোথায় ছিলেন? বাঁশখালীর শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ, বগুড়ার শহীদ খসরুর মত কি আর কেউ ছিল না? হাইব্রিড নেতাদের দাপটে ত্যাগী নেতা–কর্মীরা অসহায় এবং কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। অনেকেই আজ টাকার কাছে জিম্মি। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যেসব গুজব বা ঘটনা সৃষ্টি হয়েছিল তার কারণ, প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া সাধ্যমত উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
ইতিহাসের এই জঘন্যতম ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের স্বাধীনতার পূর্ববর্তী রাজনীতিতে আওয়ামীলীগের উত্থান ও বাঙালির অবিসংবাধিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে হবে। প্রথমবার তিনি যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, দলের মধ্যে অনেকেই সেই সময় তাঁর শত্রু হয়ে গেলেন এবং সেই শত্রুদের মাঝ থেকে দুজনকে নিজের ডানহাত–বাম হাত বানিয়ে তাঁর উপর ছড়ি ঘুরানোর সুযোগ করে দিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এ নির্বাচনের পরে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদরা যারা পাকিস্তানি ভাবধারায় বিশ্বাসী বা পাকিস্তানপন্থী ছিলেন তারা প্রকাশ্যে শত্রুতাবশত গুজবের বশবর্তি হয়ে বিভিন্ন ঘটনা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মাধ্যমে উত্তাল করে তুলল পূর্ববাংলা। গুজবের কারণে যুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের শোষণ, জুলুম ও নির্যাতন পৈশাচিক কর্মকাণ্ড আরো নির্মম হয়ে উঠল। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে ঢেলে সাজানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হতে লাগল। ঐ সময় কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্রেস্টো বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তার জনপ্রিয়তা, ব্যক্তিত্ব বাগ্মিতার কাছে ঘেষতে পারেন এমন ব্যক্তিত্ব তখন বাংলাদেশে ছিল না। ধানমণ্ডি ৩২ নং বাড়িতে নিরাপত্তার চাদর বিহীন সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় একজন সরকার প্রধান অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। এই ধরনের নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল একজন মানুষ। নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন দেশ ও দেশের মানুষকে। তাঁর নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্বের কাছে সবকিছু নত হয়ে যেত। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশে কিছু গতানুগতিক ভুলত্রুটি থাকতে পারে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়। সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী দেশগুলোতে সচরাচর কমবেশি এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। দেশের ও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীগণ প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপমানজনক, মর্যাদাহানিকর কিছু বিভ্রান্তিকর এবং ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলতে এবং লিখতে শুরু করলেন।
জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করার পাশাপাশি তাদের হতোদ্যম বা উত্তেজিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টা অবিরতভাবে করতে থাকেন। বড়বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে কালোবাজারী অবৈধ মজুতদার ও সম্পদ পাচারের মত ঘটনা নিজেরা ঘটিয়ে সরকারি দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে বহুমূখী গুজব ছড়াতে থাকে।
সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক চতুর্ভূজ উপায়ে গুজব ছড়িয়ে গুজবকারীরা মাত্র এক থেকে দেড় বছরের মাথায় পুরো পরিস্থিতি এতই ঘোলাটে করে ফেলে যে কোনও মানুষ একজন আরেকজনকে বিশ্বাসই করতে চাইত না।
ষড়যন্ত্রকারীদের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কারণে ’৭৪ এ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এ সময় গুজবের কারণে জনগণ সত্য–মিথ্যার পার্থক্য যেমন করতে পারছিল না তেমনি সর্বক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সন্দেহ প্রবণ হয়ে দেশটাকে গুজবের দেশে পরিণত করল। প্রথম শ্রেণির একটি শীর্ষ সংবাদপত্র বাসন্তির জাল পড়া ছবি ছাপালো। যা নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে রীতিমত চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার হয়ে উঠল। বাংলাদেশের ইতিহাসে হলুদ সাংবাদিকতা কাকে বলে এবং তা কত ভয়ানক হতে পারে তা হাতে কলমে নাকে চোখে কানে সুঁই ঢুকিয়ে জাসদের গণকণ্ঠ শিখিয়েছিল। আজকে আমরা যে সকল গুজবের কথা বলি জাসদ বা অন্য যারা সেদিন এই কাজগুলো করেছিল সেটা তখনকার গুজবের কাছে নিতান্তই শিশুসুলভ মনে হবে। ’৭৫ এ গুজব রটনাকারীরা অভিনব উপায়ে তাদের অপকর্মকে রীতিমত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে তারা প্রকাশ্যে মুদ্রণ অযোগ্য কদর্য ভাষা প্রয়োগ করে গালিগালাজ করতে লাগল যাতে জনগণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে শ্রদ্ধাবোধ ও মর্যাদাবোধ রয়েছে তা মুছে যায়। ’৭৩ সালে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একজন সংসদ সদস্যকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হলো। পাটের গুদামে আগুন দিয়ে, স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উচিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করলো, বঙ্গবন্ধু সংসদে দাঁড়িয়ে এই নৈরাজ্য ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, পাকিস্তানি ভাবধারায় যারা দেশকে নিতে চায় এবং আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে ভুলুণ্ঠিত করতে চায় তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে। শান্তিপূর্ণ পথ সেদিন কারো জন্য খোলা ছিল না। সুবিধাবাদীদের দ্বন্দ্ব যে কত বড় রক্তাক্ত পরিণতি ডেকে আনতে পারে তার নির্মমতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবার হত্যাকাণ্ডের চেয়ে বড় উদাহরণ আর কোনও কিছু হতে পারে না। ষড়যন্ত্রকারীদের সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত এবং তাদের সর্বশেষ পরিণতিও আমরা ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পাই। আগস্টের রক্তাক্ত ইতিহাস আমাদের জাতীয় মান মর্যাদাকে নিদারুণভাবে কলঙ্কিত করেছে। গুজব সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে শেষ পর্যন্ত সেটা কত ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে আমরা রক্তাক্ত আগস্ট থেকে সেটা শিখতে পারি। মানুষ তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে কী করতে পারে তা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের রক্তের ইতিহাসের মধ্যে দেখতে পাই। খুনীরা যাতে গুজব ছড়িয়ে হত্যা কু–ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করার সুযোগ না পায় সে জন্য তাঁর রক্তের উত্তরসূরী পাঁচবারের সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যাতে এদেশে আর কোনদিন রক্তাক্ত আগস্টের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে সন্ত্রাসীরা সেটা ’৭১ এ পাক সেনাদের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। গুজবের বশবর্তি হয়ে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছে। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী দেশ ত্যাগ করছে বলে গুজব ছড়িয়ে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মনোবল ভাঙার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয় যা অত্যন্ত ঘৃণিত। গুজব আপনার আমার সন্তানদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে। তাই গুজব থেকে সজাগ থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশের নাগরিকরা অবশ্যই গুজবকে প্রতিরোধ করবে। যে গুজবের কারণে এদেশে ১৫ই আগস্ট সৃষ্টি করেছিল খুনিরা। পুনরায় যেন সে ঘটনা না ঘটে তার জন্য দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাঁশখালী উপজেলা পরিষদ; শ্রম সম্পাদক,
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।