বৈচিত্র্যময় মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবন। এরকম বৈচিত্র্যময় জীবনের বৈচিত্র্যময় গল্প আমরা একবসাতে পড়তে পারি, দেখতে পারি, জানতে পারি, লেখকের গল্পে, উপন্যাসে, চিত্রকরের মনোমুগ্ধকর চিত্রকলায়, চলচ্চিত্রের দৃশ্যায়নে। সৃজনশীল মানুষ তার নিজের মনের সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য চিত্রায়নটুকু আমাদের সামনে তুলে ধরেন, আমাদের ভাবনার জগতে নানান খোরাক তুলে দিয়ে নিজেরা দূরে বসে দেখেন পাঠক কেমন খাবি খাচ্ছে জীবনঘনিষ্ঠ সব গল্পের ভেতর। যে গল্প পাঠের পরে ভাবনার জগতে বিচরণ করে, সেরকম কিছু ভিন্নরকম জীবনের গল্পের স্বাদ পাই গল্পকার সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্পগ্রন্থ ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’-এর গল্পগুলো পড়ে।
রক্তমূলে বিচ্ছেদ এর প্রথম গল্প ‘জলের দাগ’। বিয়ের পাঁচ বছর পর আঁটকুড়া অপবাদ থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় একসময়ের ছেলে বর্তমানের ভৈরব ঘাটের ইজারাদারের সহযোগী কাওছার এবং তার স্ত্রী শিউলির। ঘাটের ইজারাদারিতে ভালোই আয় রোজগার কাওছারের। মাঝেমধ্যে নদীর শোঁ শোঁ শব্দে পুরনো কথা ভেবে মনের মধ্যে ভাবের আনাগোনা হলেও পরক্ষণে বর্তমানের ভালো অবস্থা এবং ভবিষ্যতে ঘরে নতুন মুখ আসলে খরচ বাড়বে, তার সুন্দর আগামীর কথা চিন্তা করে সেসব ভাবকে আলগোছে মনের একপাশে সরিয়ে রাখে কাওছার। সমস্যা স্ত্রী শিউলিকে নিয়ে। সে বাস্তবতা বুঝতে চায় না। বরং নানাভাবে যা তা বলে কাওছারকে ভয়-ডর দেখায়। ভয়-ডরের মধ্যে একটা ভয় হচ্ছে, ঘাটের ওসব টাউট-বাটপারের সাথে কাজ করতে গিয়ে তার ভালো মানুষ স্বামীটা না আবার বদলে যায়। স্ত্রীর এসব ভয়ধরা ভাবনাকে হেসে উড়িয়ে দেয় কাওছার। বরং নতুন অতিথি পুত্র নাকি কন্যা হবে, দেখতে কার মতো হবে, মেয়ে হলে একটা সম্ভাব্য নামও ঠিক করে কাওছার। গল্পের এ পর্যায়ে এসে একটা সুন্দর দৃশ্যপটের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল শিউলির উচ্চারণ, ‘মইরে যাতিছি। আমার শইল্লের ভেতর মনে হতিছে গাঙ মুচরোচ্ছে’।
বইয়ের চমৎকার একটা গল্প হচ্ছে ‘নাগরিক ছাদের ঘর’। গল্পের শুরুর অংশটাই কী আকর্ষণীয়। ‘ছেড়ে যাওয়ার সময় সব কিছুর জন্য মায়া হয় মানুষের। পুরনো কাগজটা দামি হয়ে ওঠে, কোথায় কোন চৌকাঠে নেলপলিশের দাগ লেগেছে মনে পড়ে, বারান্দায় কোন কোণাটায় একা বসে সারা রাত কেঁদেছে ভেবে জায়গাটা প্রিয় হয়ে ওঠে, ছাদের কোণে ফেলে রাখা মরচে ধরা লোহার চেয়ার যেটা এতদিন চোখেও পড়েনি সেটাও সঙ্গে নিতে ইচ্ছে করে’। ভাড়া বাড়িতে থাকা মানুষগুলোর অনুভব কেমন সাবলীলভাবে উঠে এল লেখকের কলমে!
সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে চারতলা বাড়ির দোতলায় থাকেন সাংবাদিক আপা। তাকে ঘরে টুকিটাকি কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির কেয়ারটেকার ওরফে বাড়িওয়ালা ফারুকের স্ত্রী মাজেদা। বাড়ির মূল মালিক দেশের বাইরে থাকায় ফারুকই বাড়িটা দেখে শুনে রাখতে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেই সে বাড়িওয়ালার ভাব ধরতে চায়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ বিশ টাকার জন্য সেই ভাবটা মাঝপথেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মজার একটা গল্প ভেবেই আগাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষে এসে কী কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন গল্পকার। এক রুমের ঘরে মাজেদা শাশুড়ি, ছেলেকে আপ্যায়ন করে, স্বামী ফারুক মায়ের সাথে গল্প করে, মাজেদার কন্ঠ উপচে পড়া সুখ মুহূর্তেই ম্লান করে দেয় মধ্যবিত্তের নাগরিক সভ্যতার সংসার। যেখানে গেস্ট রুম নেই বলে বাবা-মা কিংবা শ্বশুর-শাশুড়িকে কাছে আনার কথা ভাবি না আমরা, প্রাইভেসির যাঁতাকলে চাপা পড়ে যায় সম্পর্কের সুতা। আর তখনই নগরের এক চিলেকোঠার নিম্নবিত্ত ঘরের সুখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন।
একজন মায়ের অনুভূতির গল্প ‘নিম সত্য’। এই গল্পটা পড়তে গিয়ে কখন যেন অশ্রুসজল হয়ে উঠেছি, নিজেও টের পাইনি। আটান্নতে পা দেওয়া পারভিন মজিদকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। নিম গাছ আর পারভিন মজিদ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নিমগাছের সঙ্গে তার স্মৃতির দাগ আছে। চলৎশক্তিহীন, প্রতিক্রিয়াবিহীন এই প্রাণটার সাথে তার ব্যক্তিজীবনের অনেক আদান প্রদান আছে। তার বাবা নিজ হাতে লাগিয়েছিল নিমগাছটি। মৃত কন্যার প্রায় সমবয়সী গাছটি কি কখনো কন্যার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে কি না তা অবশ্য জানা যায় না। তবে বড়লোক বাড়ির অনেক আদিখ্যেতার প্রাচীর ডিঙিয়ে খুবই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে শাশুড়ির, ‘দ্যাখেন ওই কোণাটোনার দিকে পুঁতে রাখা যায় কি না’ বাক্যে আমরা নিমগাছের সঙ্গে এ বাড়িতে পারভিন মজিদের অবস্থানের একটা সাহচর্য খুঁজে পাই।
এই বইয়ে আমার ভালো লাগার অন্যতম একটি গল্প হলো ‘গোর’। ফয়েজ আহমেদ নামক লোকটার অনিচ্ছাকৃত ভুল নাকি ইচ্ছে করেই নকল নোট চালিয়ে দেয়ার কৌশল তা নিয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারি না আমি। গল্পের প্রধান দুটি চরিত্রের একটি হচ্ছে ফয়েজ আহমেদ। অন্যটি সিদ্দিক। কারওয়ান বাজারে লেখকের ভাষ্য অনুসারে চতুর্থ শ্রেণির দোকানদার সিদ্দিক ফলের ব্যবসায়ী। ফয়েজ আহমেদের বাসায় অনেক মেহমান আসা উপলক্ষে তিনি বাজার করতে গেলে সেখানে সিদ্দিকের দোকানে থাকা পাকা বেল, আমড়া আর কম্ফা কেনেন পাঁচশ টাকা দিয়ে। সিদ্দিক জানায়, সে খুব ঠেকে গেছে, মেয়ের স্কুলের পরীক্ষার ফি জমা দিতে হবে তাই বেশি বাগড়ায় না গিয়ে সাতশো টাকা দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ফয়েজ আহমেদ পাঁচশ টাকায় কেনেন।
ক্রেতা কিনে চলে গেলেন আর বিক্রেতাও বিক্রি করে ক্ষান্ত হলেন। সমস্যা শুরু হলো দু’দিন পর। যখন ফয়েজ আহমেদের ছেলে দীপ্র সিঁড়ির হাতল থেকে পড়ে রক্তারক্তি অবস্থা। আর তখন থেকেই অস্থির ফয়েজ আহমেদ। ফয়েজ আহমেদ কাগজ কলম নিয়ে হিসেব মিলাতে বসেন। কিন্তু না, কোনোভাবেই তার হিসেব মিলে না। আর তখনি তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা আসে। তিনি পরদিন সকালে উঠেই চলে যান কাওরান বাজারে। সেখানে গিয়ে সেই ফল বিক্রেতাকে খুঁজতে গিয়ে জানতে পারেন তার ১৬ বছর বয়সী মেয়েটি আত্মহত্যা করে এবং ফল বিক্রেতার নাম সিদ্দিক।
তারও প্রায় দু’বছর পরে একদিন কাকতালীয়ভাবে কবরস্থানে সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ফয়েজ আহমেদের। কেমন অদ্ভুত লাগছে না? দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে কবরস্থানে দেখা হলো! ভুল কিন্তু ভাববেন না। তারা দুজনেই জীবিত। সিদ্দিক কবর খোঁড়ে। সিন্দুক কবর, বাক্স কবর। কবরের উপমাটা মনে আটকে যায়। ‘আশেপাশের দু-একদিন বয়সী কবরগুলো সদ্য মা হওয়া নারীর তলপেটের মতো ফুলে আবার চুপসে বসেছে পানিতে’।
গল্পের এ জায়গায় কৌতূহল জন্মে, ফয়েজ আহমেদ কি তবে ইচ্ছে করেই জাল নোট গছিয়ে দিয়েছে? তা না হলে ছেলে দীপ্র’র দুর্ঘটনার পরদিনই সে কেন ফল বিক্রেতাকে খুঁজতে গেল? সিদ্দিকের খেদ ভরা কথাটাই ঠিক মনে হচ্ছে। ‘না-বুইঝা করেন নাই। চালাই দিতে চাইছিলেন না স্যার? ভালোই চলছে’। ভালোই চলছে কথাটার শ্লেষটুকু কানে বাজে।
এই বইয়ের আরেকটি চমৎকার গল্প ‘কার্তিকের দিনে’। ওহাব মিয়ার মেয়ে হিমার বিয়ে নিয়ে হিমার বাপ-মার পাশাপাশি পুরো গ্রামবাসীর চিন্তা। তা ২৫ বছরের সোমত্ত মেয়ে আইবুড়ো হয়ে ঘরে পড়ে থাকলে চিন্তা তো টুকটাক সবার হবেই। তার ওপর হিমার ছোট দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় বোনকে ঘরে রেখে ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার চিত্র যেহেতু আমাদের সমাজ ব্যবস্থার স্বাভাবিক চিত্র নয়, তাই কিছুটা কৌতূহল কিংবা চিন্তা তো সমাজের লোকজনের থাকবেই। তবে হিমার মা খদেজা বেগমের চোখ রাঙানি কথাগুলো ভালোই লাগে। ‘আমার মাইয়া ডাঙ্গর হইছে না ধাড়ি হইছে তোমার পুড়ে কেন? তোমার লাউয়ের জাংলায় কি মাসিকের কাপড় দিছে নাকি?’ এমন সাহসী মা ঘরে থাকলে সে ঘরের মেয়ে নিয়ে আর বেশি হুজ্জতি করার সাহস পায় না সমাজবাসীরা।
গল্পে খটকা লাগে একটা জায়গায়। ছোট বেলায় কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক হলে একটা মানুষ এতদিন সুস্থ থাকতে পারে? কিংবা এত দিন পেরিয়ে এসে জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়? এই খানটাতে এসে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হই। গল্প লেখকের নিশ্চয়ই কোনো ব্যাখ্যা আছে।
বইয়ের নাম গল্প ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’। এই গল্পটার আখ্যান, বয়ান সব মিলিয়ে গল্পটা অনবদ্য। মফস্বলের আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা পুরোদস্তুর নাগরিক এক নারী সাংবাদিকের জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভবের নির্যাস নিংড়ানো গল্প ‘রক্তমূলে বিচ্ছেদ’। বাংলা নববর্ষের উদযাপন নিয়ে শহুরে মানুষের আনন্দ আয়োজনের রেশ ধরে আমরা চলে যাই ফরিদপুরের ছোট্ট শহরে। সেখানে চৈত্র সংক্রান্তির আগেই গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে লাল রঙের কার্ড আসতো দোকান থেকে। হালখাতা উৎসবে মিষ্টি, মিষ্টান্নের ঘ্রাণ লেগে থাকে। এই গল্পের পার্বতী পুত্র গণেশের জন্মকাহিনীটা পড়তে খুব ভালো লাগছিল। শিব পুরাণের কাহিনী থেকে লেখকের বয়ানে গণেশের হাতির নাকের গল্পটুকু ছিল বেশ আকর্ষণীয়। সততার চাপে পিষ্ট বাবা, কন্যাকে কী যেন বলতে গিয়ে থমকে যান, কন্যা কিন্তু বাবার অপরগতাটুকু উপলদ্ধি করতে পারে। পিতা-কন্যার এই নীরব কথোপকথনে কখন যেন নিজের বাবার সাথে নিজের শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে হারিয়ে যাই।
বইয়ের গল্প সংখ্যা ১২টি। আছে গ্রামীণ পটভূমি। আছে শহুরে নাগরিক জীবনের গল্প। সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের গল্প ভাষা সাবলীল। পড়তে গিয়ে কোথাও অতি জটিল শব্দ কিংবা বাক্যে হোঁচট খেতে হয়নি। গল্পগুলোর ভেতরের গল্প তার লেখনীতে জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের চোখে। দু’একটা শব্দ বিভ্রাট আছে। অবশ্য তেমন গুরুতর কিছু নয়। এগুলো চাইলেই এড়িয়ে যাওয়া যায়। বইয়ের গল্পগুলো এতই সুন্দর যে প্রতিটি গল্পই আলাদা করে পাঠ আলোচনার দাবি রাখে।
গল্পকার সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামকে ধন্যবাদ। এমন ঝরঝরে সব গল্প আমাদের উপহার দেয়ার জন্য।
প্রকাশক- অন্যপ্রকাশ
প্রচ্ছদ – ধ্রুব এষ