যৌন সহিংসতার ধরন এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে সচেতনতা

হসাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৩ মে, ২০২৫ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে যৌন সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। এর ভেতর নানান ধরন অর্ন্তভুক্ত হলেও এর কোনো সীমা নেই। বৈবাহিক ধর্ষন, পরিচিত বা অপরিচিত দ্বারা ধর্ষণ, কর্মক্ষেত্রে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ, সিস্টেম্যাটিক ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব যৌন হয়রানির মতোই অতি সাধারণ বস্তুতে রূপ নিচ্ছে; একে রেইপ কালচার সম্বোধন করছি। এছাড়াও শিশু ধর্ষণ, প্রতিবন্ধী শিশুদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ইত্যাদিও ‘প্রথাগত ধর্ষণ’র রূপ নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন গবেষণা বলছে, জীবদ্দশায় প্রত্যেক নারীই অন্তত একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ এমন কোনো নারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল যারা যৌন হয়রানির মতো বিষয়ের মুখোমুখি হননি। উন্নত বিশ্ব যেমন ইউরোপের মতো দেশেও ১৫ বছরের উর্ধ্বে নাবালিকা শিশুদের মধ্যেও ৫% অর্থাৎ ৯ মিলিয়ন কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণ শিকারের হার যদি সম্পূর্ণ বিশ্বে ০.০০০১ শতাংশ হয়ে থাকে তবুও এর প্রাদুর্ভাব ভীষণ রকমের ভয়ানক।

বিশ্বের বহু গবেষণাই মনে করে, যৌন সহিংসতা এবং এর পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে একটা উন্নত সেতু তৈরি করা উচিত। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, হতাশা, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদিও আমলে নেওয়ার মত। মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাতে আসা বিভিন্ন বয়সের নারীদের মধ্যে দেখা যায়, তাদের জীবনে হয়ে আসা যৌন সহিংসতা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য অবনতির অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, এর উলটো পিঠে দেখা যায়, যেসকল পুরুষ সদস্য পরিষেবা নিতে আসে তাদের অধিকাংশই জীবনের কোনো এক সময় অন্তত একবার হলেও ধর্ষণের কথা ভেবেছে কিংবা নিজেরাই যৌন সহিংসতার শিকার। এর ভয়ানক দিক হলো, সেসকল পুরুষের যারা পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়েছে কিংবা বুঝতে পেরেছে এটি অন্যায় তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। নিজেদের উপর হওয়া যৌন সহিংসতার জন্যেও তারা কুঁকড়ে গেছে। তাই যৌন সহিংসতার কথা বললেই কেবল নারীকে ভিক্টিম এবং পুরুষকে অন্যায়কারী হিসেবে দেখার সুযোগ আর থাকছে না। বর্তমানে যৌন সহিংসতা একটি বিশ্বব্যাপী সহিংসতা যার লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, বয়স কোনো কিছুই আর ফ্যাক্ট নয়।

বাংলাদেশসহ মধ্য আয়ের দেশগুলোতে যৌন সহিংসতা স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে যা একটি অশনি সংকেত কেননা এমন মধ্য আয়ের দেশগুলোতে দেখা যায়, যেসকল মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র রয়েছে কিংবা পেশাদার সাইক্রাইটিস কেউই যৌন সহিংসতা নিয়ে বিশেষ পড়াশোনা করেন না। তাদের নিজেদের পূর্ব ধারণা, মৌলবাদ যৌন সহিংসতার শিকার ভুক্তভোগীর জন্যে খুবই ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে আরো কিছু ভাবনা কাজ করে যেমন, অনেকেই যৌন সহিংসতা নিয়ে কথা বলাকে লজ্জার মনে করেন, কেউ কেউ মনে করেন এসব বিষয়ে কথা বললে কষ্ট বাড়বে কিংবা যৌন সহিংসতার বিষয়ে জানার পর করণীয় সম্পর্কে অবগত নন। যৌন সহিংসতা’র শিকার ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরী, তার জন্যে প্রয়োজন প্রত্যেক মানুষেরই মানসিক স্বাস্থ্য এবং পরিষেবা নিয়ে সচেতনতা।

গবেষণা সংস্থা হিউজ’র মতে কেবল যৌন সহিংসতার তদন্ত করা, রুটিন চেকআপ করা কিংবা উন্নত উপায় প্রয়োগই যথেষ্ট না। বরং যৌন সহিংসতার যেকোনো ধরণকেই জানতে হবে, এর সম্পর্কে শুনতে হবে, আমলে নিতে হবে এবং উদ্যোগী প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে তারা অস্ট্রেলিয়া নির্ভর একটি গবেষণা তুলে ধরেছে, সেখানে দেখা যায় বেশিরভাগ আদালত কিংবা ফৌজদারি মামলায় তারা ভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানি সম্পর্কে শুনলে অবাক হন, মানতে চান না, যথেষ্ট প্রমাণাদির প্রয়োজন দেখান এবং পরিষেবাগুলো সেক্ষেত্রে এধরনের তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারেন না। এমন চিত্র শুধুই যে কিছু দেশে তা নয়। যেমন এশিয়া’র বিভিন্ন দেশে এখনো বৈবাহিক ধর্ষণকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। ফলে বর্তমানে বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা কিংবা আলোচনা হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক পুরুষই বৈবাহিক ধর্ষণকে লিগালাইজ করতে চান না কারণ তারা মনে করেন এটি তাদের বিরুদ্ধে সহজেই একটি হাতিয়ার হিসেবে পরিণত হবে। তবে এও সত্য যে, এমন ঘটনাও রয়েছে কিন্তু তাই বলে যৌন সহিংসতার এই ধরনকে নাকচ করার সুযোগ নেই।

গবেষণা সংস্থা সুইনি, যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার আচরণ কেমন হওয়া উচিত বা কিভাবে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব তার জন্যে একটি মডিউল তৈরি করেন। তারা দেখেন, যৌন সহিংসতা নিয়ে কাজ করা পরিষেবাগুলো খুবই কম তহবিল পান ফলে তাদের পক্ষেক্ষ সক্রিয়ভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যাচ্ছে যা খুবই ক্ষতিকর। ভালো প্রশ্ন করার দক্ষতা, ভালো কেইস স্টাডি করার যোগ্যতা কিংবা যথেষ্ট জানাশোনার অভাবে ভুক্তভোগী মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া ব্যক্তির তথ্যের অপব্যবহারও নিত্য নতুন অন্যায়কে এক্সপোজার দিচ্ছে এবং ফৌজদারি কার্যবিধিকেও বিপন্ন করে তুলছে। সবচেয়ে ভয়ানক হলো, তারা অনেক পরিষেবাতেই লক্ষ্য করেন জোরপূর্বক কিছু ট্রিটমেন্ট দিয়ে থাকে, অযাচিত সংযম কিংবা মেডিটেশনের পরামর্শ দেয়, কোথাও দেখা যায় সরাসরি ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যক্তির অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া হিউজ’র গবেষণা দল দেখেন, উলটো অনেক ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাতে সহিংসতার শিকার হন। গবেষণা সংস্থা সুইনি তাই জোর দাবি জানিয়েছে যৌন সহিংসতা নিয়ে যেকোনো নিঃস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিতে হবে, ভুক্তোভোগীকে যথেষ্ট সেবাপ্রদান এবং তার সমস্যাকে আমলে নিতে হবে, যেসকল পরিষেবাগুলো স্পেশাল সাইক্রাইটিসের সুবিধা প্রদান করে থাকে তাদের সেবার উন্নতি করতে হবে, অভিজ্ঞপরিষেবা নির্বাচন করতে হবে এবং যৌন সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

এছাড়াও পরিষেবাগুলোর দুরবস্থার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে, যৌন সহিংসতাকে কম অগ্রাধিকার দেওয়া, অন্যায়কারী পার পেয়ে যাওয়া, পরিষেবাগুলোকে কম নজরদারিতে রাখা এবং এর কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে হস্তক্ষেপ না করা। তবে পরিষেবাগুলোর উন্নতির মাধ্যমে খুব সহজেই যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যায়, যথেষ্ট প্রমাণাদি রাখা এবং নারীর অধিকার রক্ষাতেও এগিয়ে আসা সম্ভব।

তবে অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ হতে পারে, যদি যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ভালো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন এবং বর্তমানে সুস্থ আছেন তাদের দ্বারা কোনো পরিষেবার কার্যক্রম চালানো সম্ভব হয়। যদিও এক্ষেত্রে অনেকের এসব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ কঠিন তবুও তাদের জড়িত থাকা এবং অন্যান্য ভুক্তোভোগীদের সেরে উঠতে সাহায্য করা উচিত। নতুন পন্থা অবলম্বন, তাদের যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান এবং নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিভিন্ন স্থানে মে দিবসের র‌্যালি ও সমাবেশ
পরবর্তী নিবন্ধনির্যাতিত নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা