কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে বাঙালির ললাটে যুক্ত হল সম্মান, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও গৌরবের জয়তিলক। এ স্থাপনা শেখ হাসিনা সরকারের বিশাল কর্মযজ্ঞের আরো একটি মর্যাদাবান মাইলফলক। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই টানেল বা সুরঙ্গসড়ক দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। এই টানেলের কারণে চীনের সাংহাই সিটির মতো ওয়ান সিটি টু টাউন গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম শহর ও দক্ষিণ তীরের আনোয়ারা নিয়ে যেটি, সম্ভাবনার শিল্পাঞ্চল। এই টানেল নির্মাণে বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামের গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দেশের বৃহৎ সমুদ্রবন্দর নগরী চট্টগ্রাম যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকাকে, রাজধানী করে লর্ড কার্জন পূর্ব প্রদেশে চট্টগ্রামকে সাবসিডারি হেড–কোয়ার্টার করার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংকে সাথে নিয়ে প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সুরঙ্গসড়কে যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে চীন এবং বাংলাদেশ। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চার লাইনের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। মূল টানেলে আছে দুটি টিউব, যার দৈর্ঘ্য ৩.৪ কিলোমিটার। এছাড়া টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ৫.৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দু’টি সড়ক রয়েছে। সাথে আছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ওভারব্রিজ। এই সড়কে মোটরসাইকেল ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই টানেল উদ্বোধন করবেন। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন করাই এই টানেল নির্মাণের মূল কারণ। টানেলটি চালু হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারের সাথে একটি নতুন সড়ক যোগাযোগ চালু হলো। ফলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার দূরত্ব কমে আসবে। বাঁচবে সময় এবং খরচ। এছাড়া ভবিষ্যৎ এশিয়ান হাইওয়ের সাথেও সংযোগ সড়ক স্থাপন করবে এই টানেল। উপরন্তু কর্ণফুলী নদীর পূর্বদিকের শহরাঞ্চলকে যুক্ত করে সেখানে উন্নয়নে অবদান রাখবে। ওই এলাকায় যে, শিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে সেটির কাজও ত্বরান্বিত হবে। অন্যদিকে পশ্চিমপ্রান্তে মূল চট্টগ্রাম শহরের সাথে সাগর ও বিমানবন্দরের দূরত্ব কমে আসবে। কম খরচে ভ্রমণ আরো সহজ হবে। দুই বন্দর থেকেই পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। টানেলটি নির্মাণের ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের গতি আরো বেড়ে যাবে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজও এগিয়ে
যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে। এই টানেল দেশের জিডিপিতে বার্ষিক ০.১৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। এই সুড়ঙ্গ সড়ক সম্পর্কে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর মঈনুল ইসলামের অভিমত-‘মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়কটি যদি সম্পূর্ণ হয়ে যায় তাহলে মেরিন ড্রাইভের পাশে অনেকগুলো শিল্প এলাকা গড়ে উঠবে অতএব, লংটার্ম বিবেচনা করলে এটা গুড প্রজেক্ট।’
বস্তুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বর্তমান সরকারের সুদূরপ্রসারী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল। কেননা বর্তমান বিশ্বায়নের বাস্তবতায় কানেক্টিভিটি হল উন্নয়নের একটি মৌলিক মাত্রা। দেশের শিল্পায়ন অগ্রগতি তথা সমৃদ্ধির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা একটি জনবান্ধব সরকারের অবশ্যই করণীয়। সেই আলোকে এই সুরঙ্গসড়ক বাংলাদেশের স্মার্ট রূপান্তর বলা যায়। এই টানেল যেহেতু চট্টগ্রামকে উত্তর দক্ষিণ কানেক্টিভিটির আওতায় কক্সবাজার থেকে অদূর ভবিষ্যতে চীনের ওয়াংজু পর্যন্ত প্রসারিত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ইপিজেড ও কেইপিজেড এর পণ্য পরিবহনে দ্রুত ও কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই টানেল ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান টানেল আরো একটি বিশেষ কারণে গুরুত্ববহ, তা হলো এটি চট্টগ্রামের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিবে। কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ছিল চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা তিনবারের সফল মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর লালিত স্বপ্ন। কেননা কালুরঘাট সেতু ও কর্ণফুলী সেতুর কারণে পলি জমে নদী ভরাট ও চর সৃষ্টি হচ্ছিল, প্রয়োজনে যদি কর্ণফুলী নদীর উপর তৃতীয় সেতু নির্মাণ করা হয় তাহলে অবিলম্বে নদী ভরাট এবং নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার আশংকা প্রবল ছিল। তাই তিনি সবসময়ই চাইতেন কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণ হোক। এই টানেল উদ্বোধন মানে হল এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী স্বপ্নের বাস্তবায়ন। যেহেতু চট্টগ্রাম সবসময় অগ্রগামী, তাই এর একটি মূর্ত স্মারক এই টানেল। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়–কক্সবাজার ঘিরে পর্যটনের যে অমিত সম্ভাবনা, এই টানেল বাস্তবায়নের ফলে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘতম সমুদ্রনগরী কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প সমপ্রসারিত হবে।
মনে রাখা দরকার শ্রীলংকার বার্ষিক জিডিপির সিংহভাগ আসে পর্যটন খাত থেকে। বাংলাদেশ এই খাতে অনেক পিছিয়ে আছে। এই টানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও অনায়াস হলে পর্যটন খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এছাড়া মহেশখালীর মাতারবাড়িতে গভীর সমুদবন্দর নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই টানেলের মাধ্যমে ওখান থেকে পণ্য পরিবহনের কাজ ত্বরান্বিত ও প্রসস্ত হবে ।
এই সুড়ঙ্গ সড়কের কল্যাণে কর্ণফুলীর ওপার থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় ছোট বড় ও মাঝারি শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। নতুনভাবে নগরায়ন হবে। দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। সত্যিকার অর্থে এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা শুরু করেছে শেখ হাসিনা সরকার মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধনের মাধ্যমে বিশ্বের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছেন। বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের একটি রোল মডেল। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছে। বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়ে গেছে অনেক অনেক গুণ। মেট্রোরেল প্রকল্প আরেকটি মেগা প্রজেক্ট উদ্বোধন হয়েছে ক’দিন আগে। ঢাকার যান চলাচলের স্থবিরতা দূর করে মেট্রোরেল গতি সঞ্চার করেছে। জনমনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। কর্মঘণ্টা ক্ষতি কমিয়ে অনেকটা স্বস্তি ও সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন হয়েছে। এই উড়ালসড়কে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় কমিয়ে এনেছে দুই/তিন ঘণ্টা থেকে মাত্র ১০ মিনিটে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ আওয়ামী লীগ সরকারের আরো একটি গৌরবজনক কৃতিত্ব। এটি নির্মাণের পরে রাজধানীর বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে গেছে।
সামগ্রিক বিবেচনায় দেখতে গেলে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি এ সরকারের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা দেশের সর্বাত্মক অগ্রগতির নিয়ামকও। শত বাধা আতিক্রম করে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩১তম স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন এক অবিস্মরণীয় উন্নয়নের দেশ। কোভিড–অতিমারি ও রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও মেগা প্রকল্পগুলো অব্যাহত আছে এবং বাস্তবায়ন হয়েছে অনেক। যা বিশ্বসভায় শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে সমাসীন করেছে। উন্নয়ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই উন্নয়নের রোডম্যাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। সামনেই জাতীয় নির্বাচন। যারা অগ্রগতির অন্তরায় তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে আবার ক্ষমতায় অভিষিক্ত করা প্রয়োজন। নয়তো দেশ পিছিয়ে যাবে অনেক বছর। অন্ধকারের অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় এলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুখী সমৃদ্ধ কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের যে স্বপ্ন নিয়ে শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ পৌঁছে যাওয়ার যে রূপকল্প গ্রহণ করেছেন তার সুফল পাবে দেশবাসী। বঙ্গবন্ধু টানেল স্মার্ট যোগাযোগের যে সোনালী অধ্যায় সূচনা করেছে সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু ।
লেখক: প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ