চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল চালু হচ্ছে অক্টোবরে। বহুল প্রত্যাশার এ হাসপাতালটি গড়ে তুলতে প্রায় ১৩০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানা গেছে। গত ৩০ আগস্ট প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামে সরকারি–বেসরকারি কোনো পর্যায়ে ক্যানসারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেমোথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা অপ্রতুল। মাসের পর মাস সিরিয়াল দিয়েও অপারেশন বা কেমোথেরাপি দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। কেমোথেরাপিসহ ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য মানুষকে নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রাইভেটেও কেমোথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা অপ্রতুল।
কেমোথেরাপির অবস্থা যেনতেন হলেও রেডিওথেরাপির অবস্থা নেই বললেই চলে। চমেক হাসপাতালে সীমিত সুযোগ–সুবিধা থাকলেও বেসরকারি কোনো হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেওয়া যায় না। ঢাকায়ও সিরিয়াল দিয়ে সাত–আট মাস অপেক্ষা করতে হয়। অবস্থাপন্নরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নিলেও চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। ক্যানসার চিকিৎসায় চট্টগ্রামের সার্বিক অবস্থা নাজুক মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসার আক্রান্ত রোগী এবং পরিবারই কেবল বুঝতে পারে কী দুরবস্থার মোকাবেলা তাদের করতে হয়।
এই অবস্থায় চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক এম এ মালেককে চেয়ারম্যান করে ১০১ সদস্যের ক্যানসার হাসপাতাল বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দেশে–বিদেশে মানুষের কাছ থেকে হাসপাতালের জন্য আর্থিক অনুদান সংগ্রহসহ নানাভাবে কাজ করে। মানুষের টাকায় মানুষের জন্য এই ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার কার্যক্রমে শরিক হন চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ১০ কাঠা জায়গায় ৮০ হাজার বর্গফুটের ১০ তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ নিয়ে আমদানি করা হয়েছে ক্যানসার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি। গত কয়েকদিনে সব যন্ত্রপাতি হাসপাতালে এসে পৌঁছেছে। ভারত থেকে এসেছে একটি বিশেষজ্ঞ টিম। আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে এই হাসপাতাল পরিপূর্ণ ক্যানসার চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা কত, তা জানা না গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা তথ্য অনেকের জানা আছে। ২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যানসার অবজারভেটরি ক্যানসার বিষয়ে এই তথ্যটি প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। আর ক্যানসারে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ। নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় জনস্বাস্থ্যবিদেরা এই তথ্যই ব্যবহার করছেন। অন্যদিকে গত বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম অসংক্রামক ব্যাধিবিষয়ক জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, দেশে ক্যানসারে ভুগছে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ‘দেশের ক্যানসার রোগীর তুলনায় চিকিৎসার আয়োজন অনেক সীমিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার কেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা প্রয়োজন। এসব কেন্দ্রে ক্যানসার শনাক্তসহ ক্যানসার চিকিৎসার তিন ধরনের (কেমোথেরাপি, সার্জারি ও বিকিরণ চিকিৎসা) পদ্ধতি থাকতে হবে। দেশে মানুষ ১৭ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১৭০টি ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি সূত্র বলছে, দেশে ক্যানসার কেন্দ্র আছে ৩৩টি। এর মধ্যে বিকিরণ যন্ত্র আছে ১৯টিতে। ক্যানসার চিকিৎসকদের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ক্যানসারের চিকিৎসায় দেশে কমপক্ষে ২২০টি বিকিরণ যন্ত্র দরকার। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে ৫৭টি যন্ত্র। এর মধ্যে চালু আছে ৪৩টি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো এখন বেশি মানুষকে বিকিরণ চিকিৎসা দিচ্ছে।’ বলা যায়, ক্যানসার রোগের চিকিৎসা সেবা অত্যন্ত সীমিত।
চট্টগ্রামে এ ক্যানসার হাসপাতাল গড়ে উঠলে অল্প খরচে মিলবে দূরারোগ্য এই ব্যাধির চিকিৎসাসেবা। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রামে নেই কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল। হার্ট, কিডনি, লিভার, বার্ন চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সেবার জন্য রাজধানীতে আলাদা আলাদা হাসপাতাল থাকলেও সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামের মানুষের চিকিৎসার জন্য একমাত্র অবলম্বন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। সকল ধরনের রোগীকে সেখানেই ছুটতে হয়। এতে সীমিত সক্ষমতার হাসপাতালটির ওপর চাপও বেশি। জটিল বিভিন্ন ধরনের রোগের জন্য পৃথক পৃথক বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। আশা করছি, ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের এ দাবি পূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া হবে।