কালা মিয়া তার নাম। সে গরুর দুধ বিক্রি করতো। আমি তার থেকে গরুর দুধ নিতাম প্রতিদিন। একদিন দেখি কালা তার বিয়ের কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল-‘আপনাকে আমার বিয়েতে যেতে হবে।’ সে সাদেক ভাবীকেও দাওয়াত দিয়েছিল। আমি তখন কুমিল্লা বাখারাবাদ গ্যাসের কমপ্লেক্সে থাকি। পাশেই রাস্তার ওপারে কালাদের বাড়ি, মাইল দুয়েক হবে। আমার ও সাদেক ভাবীর বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু যাওয়া হলো না। আরেকদিন আমি বাগানে বসে আছি- দেখি কালা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বলল আমার বৌভাতে আপনাদের যেতে হবে, এবার আর ছাড়ছি না। কালা আরও বলল আপনার গাড়ি বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য রাস্তা ঠিক করে রেখেছি- পুকুর পাড় ধরে গাড়ি আমাদের বাড়ির ভিতরে চলে যাবে। এবারও যাওয়া হলো না এই ভেবে- আমরা ওদেরকে তো ওভাবে চিনি না, যাবো কি না যাবো এইভেবে। কে জানতো কালা আর বেশিদিন থাকবে না! এর কয়েকদিন পরেই কালা বিদ্যুতের চুলা ঠিক করতে যেয়ে মারা যায়। এ খবর পেয়ে আমি আর সাদেক ভাবী পাগলের মতো কালার বাড়িতে যাই- যেয়ে দেখি কালা খাটিয়ায় শোয়া। তার বাবা বলছিল ‘বাবা তুই কেন এই খাটে শুইলি, এখানেতো আমার শোবার কথা। আমি কেমনে তোরে কাঁধে করে গোরস্থানে নিয়ে যাই!’ এমন সময় আমাদের দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল এবং বলল ‘আপনারা আসছেন, আমার কালা থাকলে আজ কত খুশি হইতো- আপনারা বিয়েতে আসবেন মনে করে রাস্তা বানাইছে’। একঘরে তার মা বুক ফাটা আহাজারি করছে-অন্যঘরে কালার ‘নতুন বউ’ নীরবে কাঁদছে। মাঝে মাঝে আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। ততক্ষণে দেখি আমার চোখের পানিতে বুক ভেসে গেছে। আসলে কালাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। গোয়াল ভরা গরু, গোলাভরা ধান, বিরাট বাড়ি- পুকুর দুইটা। এছাড়া অনেক জায়গা-জমি, বাড়ির আশে-পাশের জমিগুলিও ওদের ছিলো। বাড়ির ভিতরে সব রকমের দেশীয় ফল ও সবজির বাগান ছিলো। তখন মনে প্রশ্ন জাগে- তবে সে কেন দুধ বিক্রি করত–বাড়ির মানুষ বলল: ‘ছোটবেলা থেকেই কালার গরু পালার খুব সখ ছিলো, তাই পড়াশোনাও ভালো করে করে নাই’। বাড়ির বাকী ছেলে-মেয়েরা বেশ শিক্ষিত। আমাদেরকে বাড়ির সবাই বলল আপনারা বিয়েতে না আসাতে কালা মিয়া অনেক কষ্ট পেয়েছে। আপনারা চারদিনের দোয়া খায়ের অনুষ্ঠানে আসবেন। অনুষ্ঠানে আসার পর আমাদেরকে কালার বেড রুমে বসালো। অত্যাধুনিক রুম- সেখানে টিভি থেকে শুরু করে আধুনিক সব কিছুই আছে।
তারপর খাবার নিয়ে আসল আমাদের জন্য। পোলাও, কোর্মা, কাবাব, খাসির ও গরুর মাংশ, ডিমের পুডিং- আমরা অবাক হওয়াতে কালার মা বলল–‘আমার কালার অনেক সখ ছিলো–আপনাদের আপ্যায়ন করবে ভালোভাবে। আপনারা খেলে আমার কালার আত্মা শান্তি পাবে।’ আমি আর সাদেক ভাবী চোখে পানি নিয়ে খেলাম। ভাবলাম কালার বিয়েতে না এসে তাকে যে কষ্ট দিয়েছি আজ কিছুটা হলেও শান্তি পাচ্ছি এইভেবে- মনে মনে বলছিলাম- ‘কালা চেয়ে দেখো আমরা তোমার বেড রুমে সোফায় বসে খাচ্ছি- তুমি আর মনে কষ্ট রেখো না’। -এ ঘটনার পরে আমি কালা মিয়ার পরিবারকে আমার বাসায় ২/৩ বার দাওয়াত করে নিয়ে এসেছি। ওরাও সবসময় আমার জন্য চাউলের গুড়ি, পিঠা, সবজি পাঠাতো। আমিও কালার মাকে ও বউকে শাড়ি উপহার দিয়েছি। তারপর আমি যতদিন কুমিল্লা ছিলাম এই পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলাম। আল্লাহর কাছে সবসময় প্রার্থনা করি- তিনি কালামিয়াকে বেহেস্ত নসীব করেন।