সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের উত্থান, যশ, খ্যাতি- সবকিছু এ চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বাবুল আক্তার। খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন যে চট্টগ্রামে, সেই চট্টগ্রামে তাঁকে ফিরে আসতে হলো স্ত্রী খুনের আসামী হিসেবে। তার আগে এ ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা আড়াল করার চেষ্টা চালিয়েছেন তিন গত পাঁচ বছর ধরে। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে আসে খুনের মাস্টারমাইন্ড বাবুল আক্তার নিজেই।
বুধবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আদালত থেকে বাবুল আক্তারকে পিবিআই হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তায় বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় হাজির করা হয় বাবুল আক্তারকে। শুনানি শেষে বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে বাবুলকে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতে তোলার পর বিমর্ষ ছিলেন বাবুল আক্তার।
পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও নতুন করা মামলায় উল্লেখ আছে, ঘটনা সংঘটনকারীদের অর্থ দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা আজাদীকে বলেন, স্ত্রী হত্যার তিন দিন পর বাবুল আক্তার তার ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে বলেন, তার লাভের অংশ থেকে তাকে যেন তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়। সাইফুল বিকাশের মাধ্যমে ওই টাকা গাজী আল মামুনকে পাঠান। গাজী আল মামুন ওই টাকা মুসা ও তার স্ত্রীর কাছে পাঠান। গাজী আল মামুন ছিলেন খুনের মূল পরিকল্পনাকারী মুসার আত্মীয়।
পিবিআই কর্মকর্তা আরো জানান, বাবুল ও মিতু আক্তারের মধ্যে পারিবারিক কলহ ছিল এবং তা চরম আকার ধারণ করে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গায়ত্রী নামে এক নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পর্কের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, মিতু হত্যার মামলার ভিডিও ফুটেজে বাবুল আক্তারের সোর্স এহতেশামুল হক ভোলা, কামরুল শিকদার ওরফে মুসা ছিলেন। কিন্তু ঘটনার পরপর তিনি দাবি করেছিলেন, জঙ্গিরা জড়িত। তার সোর্সকে তিনি চিনলেও বিষয়টি চেপে যান। ভুলেও তিনি সাইফুল হকের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া মুসা, ওয়াসিমসহ আসামিদের তিন লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেননি।
প্রসঙ্গত, পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে গিয়ে নগরীর জিইসি মোড়ের কাছে ও আর নিজাম রোডে নির্মমভাবে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ছুরিকাঘাত ও গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। ঘটনার পরপর তিন জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়ের করেন মিতুর স্বামী তৎকালীন পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। পাঁচ বছর পর এসে জানা গেল, মিতু হত্যায় জড়িত সেই মামলার বাদী বাবুল আক্তার নিজেই।
মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার স্বামী সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের ‘সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। প্রমাণ পাওয়ার পর পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) অবহিত করা হয়। সেখান থেকে গ্রীণ সিগন্যাল পেয়ে গ্রেপ্তার করা হয় বাবুলকে।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তদন্তের স্বার্থে পিবিআই বাবুল আক্তারকে ডেকেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আক্তার পিবিআইকে কিছু প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন নি। বিষয়গুলো আইজিপিকে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকেও জানানো হয়।
মামলার তদন্ত সম্পর্কে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মিতু হত্যা মামলায় প্রথমে বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা আসেনি। পরে এ মামলায় কিছু নতুন প্রশ্ন আসে। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মামলা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।
উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার আরও বলেন, ঘটনাস্থলে মুসাকে দেখা যায়। মুসা নিয়মিত বাবুল আক্তারের বাসায যেতেন। তার অনুপস্থিতিতে তিনি বাসায় বাজারও করে দিতেন। পিবিআই জানার চেষ্টা করেছে, মুসা সোর্স ছিলেন কি-না। এটাই পিবিআই প্রমাণের চেষ্টা করেছে। মিতু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে জঙ্গি কার্যক্রমে আহত হন বলে দাবি করেন বাবুল। মৃত্যুর পর তার যে আচরণ, তা ছিল আপনজন হারানোর মতো। তাই তার কথা সবাই বিশ্বাস করেছিলেন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বাবুলকে ঢাকায় ডাকা হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার বাবুল জানান, তিনি সোমবার ৯ টায় আসবেন। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এর আগে নড়াইলে এক ব্যক্তিকে আমরা পর্যবেক্ষণে নিই। তার নাম গাজী আল মামুন। বাবুলের আরেক বন্ধু সাইফুল হককেও পিবিআই ডাকে। দু’জনই বাবুলের ঘনিষ্ঠ। তারা সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এর ভিত্তিতে পুরোনো মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। পরে তার শ্বশুরের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বাবুলকে।