যে তিনি মমতাজ সবুর

তহুরীন সবুর ডালিয়া | বৃহস্পতিবার , ১৮ মে, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

সত্য এই নয় যে মমতাজ সবুর একজন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া লেখক ছিলেন। সত্য এই নয় যে তিনি অনেক অনেক লিখেছেন। বরং সত্য এই যে তিনি লিখতে চেয়েছেন জীবন ভর। আমৃত্যু তিনি লিখে যেতে চেয়েছিলেন। যখন তিনি ক্লাস সেভেনের ছাত্রী,বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষণ তৈরি হয়েছে পাঠ্যপুস্তক আর পত্রপত্রিকার সাহিত্য পাতায় চোখ রাখতে রাখতেই। ক্লাসে সর্বোচ্চ নম্বর উঠেছে তার বাংলায়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার এই যে, সেই বয়সে তার বুকের মধ্যে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা কেনো,কিসের জন্য তিনি ঠিক অনুমান করতে পারছেন না। কি যেন তার নেই, যা সকলের আছে। সকলের বুকে হাসি আছে, আনন্দ আছে। কিন্তু তার নেই। কেন নেই! কেন এক শূন্যতা! কেন এক অব্যক্ত বেদন বুকের মধ্যে সারাক্ষণ গুমড়ে মরছে? খোঁজো খোঁজো। এ এক দীর্ঘ অনুসন্ধান।অবশেষে একদিন চাঁন্দগাও গ্রামের বাড়িতে ছোট মামা মুখ খুললেন, ‘বেগম, তোমার মা নেই। যাকে এখন তুমি মা ডাকছো ,উনি তোমার নিজের মা নন। তোমার যখন আড়াই বছর বয়স, তখন তোমার মা মারা যান।

দীর্ঘ এক হাহাকারের সমুদ্রে ডুবে গেলেন কিশোরী মমতাজ চিরকালের তরে। যা কিনা তার বাবা অ্যাডভোকেট মোফখ্‌খর সাহেব লুকিয়ে রাখতে চাইতেন পরীর মত সুন্দরী কন্যাকে আদরে সোহাগে ডুবিয়ে দিয়ে। কিন্তু বন্ধু মহলে বাবার সোহাগী মেয়ে হিসেবে পরিচিত মমতাজ ডুবে গেলেন জীবন ব্যাপ্ত এক শূন্যতার ব্ল্যাক হোলে। কিসে শান্তি মেলে এই ছোট্ট মেয়েটির এখন! কিসে মিলে আশ্রয়! কলমে আর সাদা কাগজে আশ্রয় খুঁজে নিলো ছোট্ট মমতাজ। বরাবর বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া মমতাজের গুটি গুটি লিখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে কবিতা, ছোট গল্প ও প্রবন্ধ, যা আদৃত হয় সাহিত্য মহলে,পত্রিকা অফিসে। কিন্তু না পাওয়া দিয়ে যে জীবন শুরু হয়েছিল, কেন সে জীবন মসৃণ হবে! শেষ জীবনেও দুরারোগ্য ব্যাধি কিডনী, গ্লুকোমা আর স্বজনপরিজন মসৃণ হতে দেয়নি সে জীবন।

মমতাজ ওরফে বেগম নামের মেয়েটি তো লিখতে চেয়েছেন, পড়তে চেয়েছেন, হাঁটতে চেয়েছেন স্বাধীন সত্তায়। এটি কেন মেনে নেবে সমাজ। মেনে নেবে অনেক সৎ ভাই বোন পরিবেষ্টিত পরিবার! বিয়েটা তাই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মমতাজের ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির মুহূর্তেই। তখন দেশ উত্তাল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে ঢাকার রাজপথ মিছিলে , মিটিং এ প্রকম্পিত। ঢাকার কমরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলের ছাত্রী মমতাজও স্কুল পালিয়ে মিছিলের একজন। তার হৃদয়ে ফুসছে দেশ, তার ভেতরে সবটা জুড়ে আন্দোলন, মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা আদায়ের দাবি। ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। কিছু একটা করার কিছু একটা হয়ে ওঠার প্রবল আবেগে তার ভেতরটা সবসময় থরথর করে কাঁপছে। বিশেষ করে তখন ঢাকার আজিমপুরের বাসায় তার রাজনীতি মনষ্ক পিতার ঘরে নিয়মিত আসা যাওয়া করছেন তমুদ্দুন মজলিশ, কমুনিষ্ট পার্টি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট নেতা কর্মীরা। তমুদ্দুন মজলিশ এর একজন কর্মী হিসেবে মমতাজ তাদের কাছে বুঝতে চাইছেন দেশ, সমাজ, ধর্ম ও বিশ্বপ্রকৃতির মতপার্থক্য। রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবটাতেই মমতাজের প্রবল আগ্রহ। সমস্তটাই তিনি ধারণ করতে চাইছেন নিজের ভেতর। কিন্তু মমতাজের ঘরে বিরুদ্ধ বাতাস। জীবন তাকে পাইয়ে দেবে কেন,যা সে চায়! যখন শুরুটাই হয়েছিল না পাওয়া দিয়ে!

সুতরাং বিবাহটা চাপিয়ে দেয়া হলো মমতাজের ওপর। সেই বিবাহ বন্ধনও নিজের চেনা জানা সাহিত্য সংস্কৃতি মহলের কোন জগৎ নয়। একেবারেই ভিন্ন বিপরীত জগত। দক্ষিণ চট্টগ্রামের জমিদার পরিবার। বৌ এর লেখাপড়া ও চাকরি এই পরিবারে অবাস্তব এক ভাবনা। সুতরাং সহজ হয়নি মসৃণ হয়নি মমতাজের পৃথিবীর পথ চলা। নিজের সাতটি সন্তানকে তাই তিনি এই শিখালেন পড়তে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তার চার কন্যা জন্মের পর এই জেনেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নিতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কিছু না কিছু করা চাই। বিয়েটা মুখ্য নয়, কখনোই নয়। মমতাজ সবুরের জীবন সংগ্রামে, একাকী পথ চলায় তাই যতনা তার স্বরচিত লেখার সংখ্যা বাড়ল, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি হয়ে উঠতে চাইলেন বিরুদ্ধ বাতাসে স্বাধীন সত্তার এক মানুষ। সকালে ঘুম ভেঙ্গে তার সন্তানরা দেখতো একটি ছোট টুল সামনে রেখে নিচু মোড়ায় বসে তিনি লিখে চলেছেন। ঠিক সেই সময় হয়তো তাদের পাড়াপ্রতিবেশীর মায়েরা রান্নাঘরে ডালের ফোড়ন নিয়ে ব্যস্ত। সারাটা জীবন তার এই হয়ে উঠতে চাওয়া। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে কিছু একটা হয়ে ওঠার, নিজের ভেতরের মানুষটাকে দাঁড় করানোর প্রবল এক সংগ্রাম মমতাজের। সিটি কর্পোরেশনের (তৎকালীন সময়ে মিউনিসিপ্যালিটি) চাকরি থেকে স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস। ঠিক হেডমিস্ট্রেস হওয়ার মুহূর্তে পরিবারের চাপে চাকরিটা ছেড়ে দিতে হলো। যেরূপ বারবার কলেজে ভর্তি হয়েও পড়াটা শেষ করতে পারছিলেন না।

মমতাজ লিখছেন, পত্রপত্রিকায় ছাপছেন, রেডিও অফিসে যাচ্ছেন, সবুজ পাতায় লিখে টুকটাক টাকাও পাচ্ছেন। কিন্তু তিনি ক্রমশ হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন। একটা বই প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে পেয়ে বসেছে। অবশেষে বাবা এডভোকেট মোফখ্‌খর সাহেব ঢাকায় তার এক মক্কেলের প্রেস থেকে মামলার ফি না নিয়ে তার পরিবর্তে মমতাজের প্রথম গল্প গ্রন্থ রূপান্তরপ্রকাশে সাহায্য করলেন। পরবর্তী বইগুলো প্রকাশের পথও অতো সুগম হয়নি। সবটাই লড়াই,সবটাই বন্ধুর পথে হাঁটতে গিয়ে রক্ত ঝরানো, ক্ষতবিক্ষত হওয়া। কোন এক বইমেলায় জ্যেষ্ঠ কন্যা মহুয়ার ক্লাসমেট কবি মিনার মনসুর বিশিষ্ট রম্যসাহিত্যিক ফাহমিদা আমিনের সাথে মমতাজের পরিচয় করিয়ে দেন। ফাহমিদা আমিন প্রস্তাব দিলেন, ‘মমতাজ আপা আপনি আমাদের লেখিকা সংঘে আসেন।’ মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মমতাজের স্কুল জীবনের সিনিয়র বন্ধু রওশন জাহান রহমান ডাকলেন, ‘বেগম আসো আমার মহিলা সমিতিতে‘, বেগম রুনু সিদ্দিকী ডাকলেন ইসলামী পাঠাগারে। মহিলা পরিষদের নেত্রী নুরজাহান খান বললেন, ‘মমতাজ আপা আসেন আমরা একসাথে কাজ করি।

মমতাজ সর্বত্র যান। কখনোবা চুপ করে বসে থাকেন ঘরে। কিসে শান্তি কিসে মুক্তি! খোঁজো খোঁজো। মমতাজের একজীবনে প্রতিনিয়ত নিজেকে খোঁজা, প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হতে হতে নিজের ভেতরে চিৎকার করা, হে নারী জীবন। একে ছাপিয়ে যাও, একে প্রত্যাহার কর, এর উর্ধ্বে ওঠো। কতদূর কতদূর উঠতে পেরেছিলেন মমতাজ! কতদূর উঠতে পারে একজন নারী বিরুদ্ধ বাতাসে। সুতরাং মমতাজের জীবন সংগ্রাম একজন সাহিত্যিক হওয়া না হওয়া নয় বরং একজন মানুষ হিসেবে সোচ্চার হতে চাওয়া। লিঙ্গ বৈষম্যের অবসানে মানুষ পরিচয় এবং মানব ধর্মকে ব্রত মানা। নিজের অবস্থান এবং আত্মমর্যাদার প্রশ্নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে চাওয়া। তাই তিনি মহিলা পরিষদের সাথে হেঁটেছেন, অসহায় নারীদের জন্য থানা পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। অকালে মাতৃহারা মমতাজের বোধোদয়ের গভীরে ছিলো সমগ্র নারী সমাজের অসহায় অবস্থানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রোধ যন্ত্রণা।জাগো হে নারীএই আত্মচিৎকার ছিল তার ভেতরে। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন তার পরিবার তার আশেপাশের মানুষজন কতটুকু মূল্যায়ন তাকে করেছিল? সম্ভব ছিল না আসলে। যুগের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন মানুষের চিন্তা চেতনাকে অনুধাবন করতে পারা। মূল্যায়ন তো বহু দূরের ব্যাপার।

মমতাজ তার প্রচুর লিখা হারিয়েছেন। অগ্রজপ্রতিম প্রিয় কবি গোলাম মোস্তফা মমতাজকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি তার প্রেস থেকে মমতাজের বই ছাপিয়ে দেবেন বলে আগ্রহ ভরে পান্ডুলিপি নিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রেসটি তাকে বিক্রি করে দিতে হয়। সেই সাথে হারিয়ে যায় মমতাজের পাণ্ডুলিপি। একবার পাথরঘাটার বাসায় আগুন লেগে মমতাজের সব লিখা পুড়ে যায়।

মমতাজের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে অন্যতম রূপান্তর‘ (ছোট গল্প গ্রন্থ), ‘বাবার চিঠি‘ (কাব্যগ্রন্থ),’রূম্পা সোনার স্বপ্ন‘ (ছোটদের গল্প গ্রন্থ), “নীল যন্ত্রণা‘ (গল্প গ্রন্থ), ‘কান্না হাসির পান্না‘ (কাব্যগ্রন্থ্থ), ‘আমার স্মৃতি আমার জীবন‘ (আত্মজীবনী)

মমতাজ সবুরের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১১ই জানুয়ারি, মৃত্যু ২০১২ এর ৫ই মার্চ। স্বামী বিশিষ্ট আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ আবদুস সবুর। কলকাতা ইসলামিয়া ডিগ্রি কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান। বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আবদুস সবুর। মমতাজের আট সন্তানের মধ্যে সাত সন্তান জীবিত। তাদের একটু পরিচয় দেই। প্রথম সন্তান এ এইচ এম কফিলউদ্দিন সিনিয়র জিএম, এলিট পেইন্ট গ্রুপ অব কোম্পানিজ, দ্বিতীয় সন্তান বোরহান উদ্দিন বিচারপতি, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, তৃতীয় সন্তান সাহীন সবুর মহুয়া শিক্ষাবিদ, কবি ও গল্পকার, চতুর্থ সন্তান নাসরিন সবুর জুলিয়া শিক্ষাবিদ, পঞ্চম সন্তান তহুরীন সবুর ডালিয়া লেখক, ষষ্ঠ সন্তান এএইচএম জিয়াউদ্দিন আইনজীবী, চট্টগ্রাম বার কাউন্সিলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সপ্তম সন্তান নাহিদ শিরীন ব্যাংকার ও আবৃত্তিকার।

আগামী ২০ শে মে শনিবার, বিকাল সাড়ে পাঁচটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে‘, চট্টগ্রাম একাডেমি প্রবর্তিত মমতাজ সবুর সাহিত্যসম্মাননা ও পুরস্কার ২০২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বারের মতো সম্মাননা গ্রহণ করবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য কবি ও সাহিত্য শিল্পী কামাল চৌধুরী। প্রথম বার মমতাজ সবুর সাহিত্য সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছিলেন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। প্রিয় কবি কামাল চৌধুরীকে অভিনন্দন। মমতাজ সবুরের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

লেখক : কবি ও গল্পকার; সাবেক অধ্যক্ষমহিলা কলেজচট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসবের পর্দা উঠল