আমার মেয়ে ট্রেন খুব পছন্দ করতো। বাসার সামনে দিয়ে ট্রেন গেলে সে ছুটে যেত জানালার কাছে। আমাকে ডেকে দেখাত, ঝিক্ ঝিক্ শব্দ করে আমাকে নেচে নেচে তাকে দেখাতে হতো। এসব দেখে সে হাসত খিল খিল করে। যে ট্রেন এক সময় তাকে আনন্দ দিত, সেই ট্রেনই কেড়ে নিল আমার মেয়ের প্রাণ। আমার মেয়ে ব্যথা দূরে থাক একটু বকাও সহ্য করতে পারত না। ওর মা বকা দিলে সাথে সাথে কান্না করে আমাকে বলতো– পাপ্পা আম্মু বকা দিছে। এসব কেবল এখন শুধুই স্মৃতি।
গত ৫ জুন (বৃহস্পতিবার) রাত ১০টার দিকে কালুরঘাট সেতুতে কঙবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এঙপ্রেসের ধাক্কায় প্রাণ হারায় বোয়ালখালী পৌরসভা ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাজ্জাদুন নুর মিঠুর ২ বছরের শিশুকন্যা মেহেরিমা নূর আয়েশা। নিজ বাড়িতে বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন সাজ্জাদুন নুর মিঠু। একমাত্র কন্যাকে হারিয়ে তার কান্না যেন কিছুতেই থামছেই না। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর গোমদণ্ডী বাংলাপাড়ার প্রবাসী আবুল মনছুরের ছেলে সিএনজি টেঙি চালক তৌহিদুল ইসলাম তুষার (২৫)। এছাড়া অন্তত ১৫ জন এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। ট্রেনটি ‘ডেড স্টপেজ সিগন্যাল’ না মেনে কালুরঘাট সেতুতে উঠেছিল বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ফলে সেতুর ওপর থাকা কয়েকটি সিএনজি টেঙি, একটি মাইক্রোবাস ও কয়েকটি মোটরসাইকেল ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে–মুচড়ে যায়।
জান আলী হাট স্টেশন মাস্টার নেজাম উদ্দিন বলেন, কালুরঘাট সেতু ‘ডেড স্টপেজ সেতু’। প্রতিটি ট্রেন সেতুতে ওঠার আগে দাঁড়িয়ে যাবে। সেখানে ডেড স্টপেজ বুকে স্বাক্ষর করতে হয়। পাশাপাশি সেতু পার হওয়ার সময় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতি তোলা যায় না। বৃহস্পতিবার রাতে পর্যটক এঙপ্রেস ট্রেনটি গোমদন্ডী স্টেশন পার হয়ে ডেড স্টপেজ সংকেত না মেনে দ্রুত গতিতে সেতুতে উঠে যায়। সেতুতে একটি সিএনজি টেঙি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পশ্চিম পাশ থেকে পার হওয়া কিছু গাড়ি সেতুতে আটকে ছিল। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর চার রেলকর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। গত শুক্রবার (৬ জুন) সকালে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (সিনিয়র তথ্য অফিসার) রেজাউল করিম সিদ্দিকী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, ট্রেনের গার্ড সোহেল রানা (হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম), লোকোমাস্টার গোলাম রসুল, সহকারী লোকোমাস্টার আমিন উল্লাহ এবং অস্থায়ী গেটকিপার মাহবুব (টিএলআর)। গঠিত তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ডিএমই (লোকো), ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার–১ ও বিভাগীয় চিকিৎসক (পাহাড়তলী)।
নিহত শিশু আয়েশার বাবা গ্রাফিকস ডিজাইনার সাজ্জাদ বলেন, ঈদুল আজহা উপলক্ষে স্ত্রী জুবাইরা ইশরা ও দুই বছরের মেয়ে মেহেরিমা নূর আয়েশাকে নিয়ে সিএনজি টেঙি করে চট্টগ্রাম শহর থেকে বোয়ালখালী যাচ্ছিলেন। এসময় কালুরঘাট সেতুতে দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। এতে আয়েশা ও জুবাইরা গুরুতর আহত হন। তাদের উদ্ধার করে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে আয়েশাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। জ্ঞান ফেরার পর থেকে স্ত্রী বারবার মেয়েকে দেখতে চাইছে।
দুর্ঘটনায় নিহত সিএনজি টেঙি চালক তুষারের বাবা আবুল মনছুর বলেন, আমার ঘরে এখন শোকের মাতম। ছয় দিন আগে ভাতিজি খালেদা বেগম হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এরমধ্যে দুর্ঘটনায় একমাত্র ছেলেকে হারালাম। এই শোক কিভাবে সহ্য করব জানি না। তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে দুইটার বিয়ে দিয়েছি। আমি দীর্ঘদিন দুবাইতে ছিলাম। ২০১৪ সালে দেশে চলে আসি। এরপর জমানো ও ঋণের টাকায় একটা সিএনজি টেঙি কিনে তুষার। সেটি চালিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল সে। অসুস্থ হওয়ার কারণে নিজে ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে পারি না। তুষারের ওপরই নির্ভর ছিল আমার পুরো পরিবার। শুক্রবার ছেলেটিকে চিরদিনের মত কবরে শুইয়ে দিয়ে এলাম।
এদিকে গত ৮ জুন (রোববার) রেল সেতুতে আবারও লাল সংকেত অমান্য করে ট্রেন উঠে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা প্রবাল এঙপ্রেস ট্রেনটি জান আলীর হাট স্টেশন অতিক্রম করে লাল সংকেত উপেক্ষা করে ব্রিজে উঠে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ব্রিজের ওপর সে সময় কোনো যানবাহন না থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় ট্রেনটি। বিষয়টি নিয়ে রেলওয়ের অভ্যন্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, আমরা ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। সহকারী চালক, চালক ও গার্ড–তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
