সূর্যটা ঠিক মাথার উপরে একটু পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। বৈশাখের তপ্ত রোদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ১নং রোডের একটি কমিউনিটি হল থেকে বিয়ের দাওয়াত সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। সহয্যাপাড়া, কারিগরপাড়া, বখতেয়ার ফকির বাড়ি রোডের উত্তর পাশে চট্টগ্রাম–নাজিরহাট রেলওয়ের শাখা লাইনটি সহয্যাপাড়ার বুক চিড়ে সদর্পে চলমান। পূর্বে কারিগরপাড়া, পশ্চিমে বখতেয়ার ফকির বাড়ি। এ এলাকা আমার কর্মজীবনের নানা কাজের সংশ্লিষ্টতায় একান্ত পরিচিত। ষোল বছরের অবসর জীবনযাপনের সময়টাতে প্রায় বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল। দাওয়াতের সুবাদে সেই এলাকায় পৌঁছার পর অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে জেগে উঠল। তখনই ঠিক করলাম বাড়ি ফেরার প্রায় এক কিলোমিটার পথটা হেঁটেই যাব। তপ্তরোদে খুব বেশি লোকজন রাস্তায় থাকবে না। নিজের মত করেই পথ চলতে চলতে বাড়ি পৌঁছে যাব। বরাবরই আমার মনটা উৎসুক হয়ে উঠে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকতে। তাই আমি কমিউনিটি হল থেকে পদদ্বয়ের উপর ভরসা করে পথচলা শুরু করলাম। খুব তাড়াতাড়ি পথ ফুরোবে সেখেয়ালতো আমার ছিলোও না।
কর্মজীবনে প্রতিনিয়ত যে বাড়িতে আমার যাওয়া আসা হতো, যেপথে দুধারের মানুষের সাথে আমার শুভেচ্ছা বিনিময় হতো, সেই ফজলুল হক চৌধুরীর বাড়ি, সেই বটতলার পুকুর পাড়ের পথ, রেললাইনের পাশ ঘেঁষে সেই চিরচেনা রাস্তা, যেটি ফজলুল হক চৌধুরী সাহেবের উদ্যোগে সমন্বিত এলাকার মানুষের অবদান যাঁরা কৃতজ্ঞতা বশতঃ এই রাস্তাটির নামকরণ করেছেন ফজলুল হক চৌধুরী রোড। মনস্থির করলাম সেই রোড দিয়ে সহয্যাপাড়া ও বখতেয়ার ফকির বাড়ির মাঝখান দিয়ে, ফজলুল হক চৌধুরীর বাড়ির সামনে দিয়ে সে বাড়িতে নাগেলেও একবার চোখ ফিরিয়ে দেখা হবে যেখানে ফজলুল হক সাহেবের সাথে বসে স্কুল গড়ার নানা কাজ ও সমস্যা নিয়ে একান্ত আলাপ হতো, সমাধান আসত, বাস্তবায়ন হতো, সে বাড়ীর পাশ কাটিয়ে একান্ত পাড়া প্রতিবেশী আপনজনদের চলার মেঠো গ্রাম্য পথ পেরিয়ে, বটতলার পুকুর পাড় দিয়ে জোবরা ফতেপুরের সীমানা প্রদর্শিত রাস্তায় গিয়ে আমার সেই প্রায় সারা জীবনের কর্মস্থল জোবরা পশ্চিমপট্টি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের দক্ষিণ পাশে ঘেঁষে বিদ্যালয়টা একবার দেখতে দেখতে চবি ২নং রোড ধরে উত্তর পাশের জোবরা বড়ুয়া পাড়ায় পৌঁছে যাব। এরকম একটা পরিকল্পনায় মনের প্রশান্তি এত গভীর হয়ে দেখা দিল যে বার্ধ্যকের ভারজনিত হাঁটার ক্লান্তির অবসাদ চিন্তা আমার মনের কোণে কোন ঠাঁই করতে পারছিল না। চবি ১নং রোডের রেলক্রসিং এর সামান্য পথ হেঁটে পশ্চিম দিকে আসতেই ফজলুল হক চৌধুরী রোডের মিলনস্থলে পৌঁছালাম। সেই পথ ধরলাম, হাঁটছিলাম, মাত্র কয়েক গজ পেরোতেই রাস্তার নাম ফলকটি চোখে পড়ল, সেটি লতাকীর্ণ ঝোপঝাড়ের আড়ালে মস আর ফাঙ্গাসের আবরণে প্রায় চোখ এড়ানোর অবস্থায় অবহেলার ছবিই প্রদর্শন করছিল। ফজলুল হক চৌধুরী নেই, দুদশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে তার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার। ছেলে মেয়েরা তো আছে, তারা প্রবাসী। দেশে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়ে প্রতিষ্ঠিত, সবার উপরে এলাকায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ লোকজনেরা তো আছে। কেন নামফলক আর রাস্তার এ হতদশা। আমরা কি কারো জন্য কেউ নই! কেন এমন হবে! ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম ধীর পদবিক্ষেপে। তপ্তরোদে জনবিরল পথটাতে আমার স্মৃতিময় মুহূর্তকে চমকে দিল এক তরুণ। কিছু তফাতে দাঁড়িয়ে সে আমাকে দেখছিল কাছে আসতেই আমার এ পথে আসার বিশেষ করে এই তপ্তরোদে পায়ে হেঁটে পথচলার বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে প্রথমে সে আমার কুশল জানতে চাইল। আমি অবাক, এই তরুণ আমার সম্পূর্ণ অজানা, জানাদের যাঁরা তারা হবে ছাত্র/ছাত্রী অথবা তাদের পিতামাতা। তাদের বয়স নেহায়েৎই ত্রিশের কোটাতো অবশ্যই পেরোবে, এ তরুণ ত্রিশের নিচে। উৎসুক দৃষ্টিতে যখন তাকাচ্ছিলাম সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই নিজ থেকেই বলল, ফজলুল হক চৌধুরী তার নানা। আমার পথ চলায় তার অপেক্ষা, আমার প্রতি তাঁর মনযোগ, সবকিছুই এই যাত্রায় পরিষ্কার হয়ে গেল। বললাম, তুমি আমাকে চিনেছো। উত্তর আসলো,‘হ্যাঁ’। লম্বাটে চেহারার গৌরবর্ণ এ তরুণ যেন মহূর্তেই আমার আপন হয়ে উঠল। একাকী পথচলার বিমর্ষভাব কাটিয়ে আমার স্মৃতিপটে অনেক ছবি এসে ভীড় করতে লাগল। জানার উৎসুক্য নিবারণ করতে পারলাম না, জানতে চাইলাম সে কোন দম্পতির সন্তান, কী নাম তার। উত্তর আসল, মোহাম্মদ জানে আলম, খালেদা ইয়াছমিন দম্পতির সন্তান কাজল, হেসে বললাম তোমার আব্বু আম্মু দুইজনেই আমার ছাত্র–ছাত্রী। এ তরুণ তখনই অত্যন্ত আপন হয়েই বলল, আমাদের বাড়ী চলেন। আমি তো যাব সেপথেই, কাজলের বাড়ীর পূর্ব পাশে ফজলুল হক চৌধুরীর বাড়ি। মাঝখানে রাস্তা। আমার বাড়ী ফেরার মানসে রাস্তাতো সেটাই। কমিউনিটি হল থেকে অল্প কতদূর রাস্তা হেঁটেই একাকীত্বের অবসান হলো তরুণের সান্নিধ্য পেয়ে। নির্ভার হলাম বাকী পথ যাত্রায়। এই নির্ভার যাত্রা আমার অতীত নিয়ে চিন্তার ফসল, তাই কৃতার্তবোধ করলাম।
জিজ্ঞেস করতেই তরুণ বলল, তার পুরো নাম মোহাম্মদ ইফতিয়াজুল আলম কাজল। বলা শেষ না করতেই জানতে চাইলাম ফজলুল হক চৌধুরী রোডের এ করুণ দশা কেন? কেনই বা রাস্তার মাথায় বসানো নাম ফলক নানা আবরণে অস্পষ্ট? কাজল তখনই বলল, রাস্তাটি সংস্কারের কাজেই সে বেরিয়েছে এবং বাড়ি ফিরছে। কোয়ার্টার কিলোমিটার পথ এ রাস্তা দিয়ে হেটে কাজল আমাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে। আমার আগমন সংবাদ পেয়ে তাঁর মা বাবা দুইজনেই ঘর থেকে বের হয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। আমি তখন বহু স্মৃতির পাথারে সাঁতরাতে সাঁতরাতে অশ্রুভেজা নয়ন, ফজলুল হক চৌধুরী এবং তার সহধর্মীনির হাজার স্মৃতির আড়ালে তাঁদের কনিষ্ঠা কন্যা মোছাম্মৎ খালেদা ইয়াছমিনও চোখের পানিতে ভাসছিল। নির্বাক দন্ডায়মান জানে আলম, স্পর্শকাতর ইফতিয়াজুল আলম কাজল অবাক! ফজলুল হক চৌধুরীর পরিবারের সাথে আমার এরকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তার কল্পনাতেও কোন সময় স্পর্শ হয়নি।
এ সম্পর্ক আমাদের এ ধারণাই দিতে পারে যে, ধর্মটা নেহায়েৎই নিজের একান্ত “মানুষের জন্য মানুষ” এ আপ্ত বাক্যটাই মানবিক সম্পর্ক রচনায় অনাবিল সম্পর্কের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। আমি বৌদ্ধ, ফজলুল হক চৌধুরী মুসলমান। নামের ভাষাগত পার্থক্য, র্ধমের আলাদা বৈশিষ্ট্য, পারিবারিক হালচাল কোনটাই এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নি, তাহলে তো শুনহ মানুষ ভাই “সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই”। কবির এ আহ্বান মিথ্যে পরিণত হতো। আমি ফজলুল হক চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত জোবরা পশ্চিম পট্টি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ফজলুল হক চৌধুরী পরিচালনা পরিষদের সভাপতি। যখনই নব প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের কোন কাজ বা সমস্যা দেখা দিত সে প্রয়োজনে তাঁর বাড়ী গেলেই মাতাপিতৃ স্নেহে আপ্লুত হতাম। অথচ আলোচনায় যখন সিদ্ধান্তে আসতাম সেখানে আমার মতামতেরই প্রতিফলন ঘটত বেশি। তাঁর মধ্যে কখনো আমাকে প্রভাবিত করার বিন্দুমাত্র স্পষ্টতাও ছিল না।
লেখক : সাবেক প্রধান শিক্ষক, জোবরা পশ্চিম পট্টি উচ্চ বিদ্যালয়, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।