যে গাড়ি এখন কেবলই স্মৃতি

মীরসরাই প্রতিনিধি | শনিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২১ at ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ

ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে- এ ধরনের ভাওয়াইয়া গান মূলত দেশের উত্তর জনপদের প্রচলিত এক প্রকার পল্লি গীতি। গরুর গাড়ি কেন্দ্রীক এ গান এখন কেবল গ্রামবাংলার পুরনো দিনকে স্মরণ করে দেয়। কেননা দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলার গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় গরুর গাড়ি বিলুপ্তি প্রায়। কোনো কোনো সৌখিন এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ ঘোড়ার গাড়ির দেখা মিললেও গরুর গাড়ির দেখা মেলা ভার। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকায় দুয়েকটি গরুর গাড়ি হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়লেও শহর কিংবা শহরতলীতে একেবারেই দেখা যায় না। মীরসরাই উপজেলার বিভিন্নস্থানে একসময় গরুর গাড়ির বেশ প্রচলন ছিল। উপজেলার ইছাখালী, ঝুলনপুল, মাতবরহাট, কমরআলী, আবুরহাট, আবুতোরাব এলাকায় গরু ও মহিষের গাড়ি অনেকের বিকল্পহীন অবলম্বন ছিল একসময়। গত এক দশক আগে পর্যন্ত শখ করে গরুর গাড়িতে করে বিয়ে করা এবং নাইওর নেয়ার চলও ছিল বেশ। একসময় চট্টগ্রাম শহর ও দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হত গরুর গাড়ি যোগে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজেও গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক। অনুমান করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। সেখান থেকে ক্রমাগত তা দক্ষিণের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও দক্ষিণ আফ্রিকার যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। এইচ রাইডার হ্যাগার্ড এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিং সলোমনস মাইনস’ উপন্যাসেও গরুর গাড়ির বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাতে বিশ্রাম নেয়ার সময় বা বিপদে পড়লে তারা গরুর গাড়িগুলোকে গোল করে সাজিয়ে একধরনের দুর্গ গড়ে তুলে তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করত। চেঙ্গিস খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে মোঙ্গল আক্রমণ চলে সেখানে তার প্রতিরোধে স্থানীয় অধিবাসীরা গরুর গাড়ি ব্যবহার করেছিল।
দুই যুগ আগে আমাদের দেশের অনেক স্থানে শখ করে নববধূ নাইওর যেত গরুর গাড়িতে চড়ে। কোনো কোনো অঞ্চলে গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়েই হত না। বর পক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্যে ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাউনি সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করত। রাস্তা-ঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাতো। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করত। অনেক অঞ্চলে রাস্তা পাকা না থাকায় একসময় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করত না। ফলে গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। বর্তমানে মোটরচালিত যানের আধিক্যে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার নাই বলেলেই চলে। শুধুমাত্র পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালনের সময় গরুর গাড়ির দেখা মিলে কোথাও কোথাও। বড়রা ছোটদের তা দেখিয়ে পুরনো দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে নতুন শনাক্ত পাঁচ, মৃত্যু এক
পরবর্তী নিবন্ধটেলিস্কোপে শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ দেখল শিক্ষার্থীরা