আজকের দুনিয়া অভাবিত বেগে এগিয়ে চলার দুনিয়া। এই গতি ও বেগ প্রযুক্তিগত। প্রযুক্তিগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রূপান্তরের এই পর্যায়কে অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তিবিদরা নাম দিয়েছেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এ বিপ্লবটি মূলত তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বিপ্লব। এই বিপ্লব সৃষ্টি করছে নানামুখী সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ। যেমন অটোমেশনের প্রভাবে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি হ্রাস, উৎপাদন শিল্পে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাখাতে বড় পরিবর্তন, বিশেষায়িত পেশার চাহিদা বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। এতে সনাতনী কাজের অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশও স্বাভাবিকভাবে এর ছোঁয়াচমুক্ত থাকতে পারবে না। বিষয়টি সম্যক উপলব্ধি করে সরকারও তথ্যপ্রযুক্তিতে জোর দিচ্ছে, ডিজিটালাইজেশনের পথে হাঁটছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। তার সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষার বিস্তার ঘটে চলেছে। সম্প্রসারণশীল বাজারের কারণে এ বিষয়ে কদর বাড়ছে।
কিন্তু দেশে বেকারত্ব দ্রুত বাড়ছে। ক্রমেই প্রকট হচ্ছে করোনার অভিঘাত দেশের অর্থনীতিতে। ছোটোখাটো অনেক ব্যবসায়ে ধস নেমেছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। তার প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। দেশে বেশিরভাগ কর্মসংস্থান হয় বেসরকারি খাতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা বলছে, বেসরকারি খাতে যারা কাজ করেন তাদের ১৩ শতাংশ এরই মধ্যে কাজ হারিয়েছেন। চাকরি থাকলেও বেতন নেই এমন মানুষের সংখ্যা আরো বেশি। আর ২৫ শতাংশ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। নতুন নিয়োগ থমকে গেছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, অনেকেই শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছে। সেখানেও আয়ের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা না থাকায় তাদের দুরবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। এ অবস্থা যদি একইভাবে চলতে থাকে তাহলে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নেবে। করোনায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই ধুঁকছে। যুক্তরাষ্ট্রে এরই মধ্যে বেকারত্ব অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে প্রায় একই অবস্থা। সেসব দেশ আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। আর তার বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে। ধুঁকে ধুঁকে চলছে অনেক কারখানা। ছোটোখাটো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তার সংখ্যাও চার শতাধিক হবে। অনেক কারখানায় ব্যাপকহারে ছাঁটাই করা হয়েছে। অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় কিছু লোক চাকরি ফিরে পেলেও এখনো বেকার প্রায় এক লাখ শ্রমিক। শিল্প পুলিশের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এক হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তা যদি হয় তাহলে তাতে বেকার হয়ে পড়তে পারে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক। অন্য কিছু শিল্পখাতেও বড় ধরনের ধস নামতে পারে এবং বহু শ্রমিক বেকার হয়ে পড়তে পারে। ধস নামতে পারে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও। বেসরকারি শিক্ষকরাও রয়েছেন প্রবল চাপে। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতনের সরকারি অংশের বাইরে শিক্ষকেরা কিছুই পাচ্ছে না। ননএমপিও শিক্ষকরা তাও পাচ্ছে না। টিউশনিরও সুযোগ নেই। বেসরকারি অনেক ব্যাংকেই কর্মীদের বেতন কমানো হয়েছে হচ্ছে কর্মী ছাঁটাই। পর্যটন, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ অনেক খাতেই চলছে কর্মী ছাঁটাই অথবা কম বেতন দেওয়া। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৭ সালে দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি ৩৫ লাখ (১৫-৬৫) বয়স। এর মধ্যে ২৭ লাখ ছিল বেকার। ছদ্মবেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৬ লাখ। বর্তমানে বেকার ও ছদ্ম বেকারের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে।
বড় অর্থনীতির দেশগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও নানাভাবে প্রণোদনা বা সহযোগিতা যুগিয়েছে। ফলে সেসব দেশে করোনায় প্রভাব ততটা মারাত্মক হতে পারেনি। বাংলাদেশেও বিভিন্ন খাতে ঋণ সুবিধাসহ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব বাস্তব সুবিধার তুলনায় খুবই কম। সরকারকে মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তাঁর বহুমুখী প্রভাব পড়ে সমাজে। এর ফলে দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও শুভ হয় না কখনো। তাই, কর্মসংস্থান অটুট রাখার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।