যে কারণে ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে কর বেশি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ at ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের চেয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ বেশি পৌরকর (গৃহকর ও রেইট) আদায় করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। অথচ নাগরিক সুযোগসুবিধা ঢাকার চেয়ে তুলনামূলক কম নিশ্চিত করতে পারে সংস্থাটি। চট্টগ্রামে আদায়কৃত পৌরকরের মধ্যে গৃহকরের সাথে বর্জ্য অপসারণ এবং সড়কবাতি খাতে দুই ধরনের রেইটও ধরা আছে। যদিও সেবা দুটি শতভাগ নিশ্চিত না করার অভিযোগ আছে। একইসঙ্গে সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট২০০৯ অনুযায়ী, নাগরিক স্বার্থে সড়ক মেরামতসহ ২৮ ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে চসিকের। যার বেশিরভাগই করে না সংস্থাটি।

ঢাকার চেয়ে পৌরকর বেশি আদায় বিষয়ে চসিকের সাবেক মেয়রগণ বলছেন, চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকায় স্থাপনা বেশি। আবার আয়বর্ধক প্রকল্পও বেশি। এছাড়া চসিকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ রয়েছে। খাত দুটিতে প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হয় প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ঢাকায় বর্ধিত এ ব্যয়ের বোঝা নেই। ফলে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয় পৌরকর দাতাদের। দুই সিটির সঙ্গে পার্থক্য : সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে চসিক সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। এর মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ড থেকে ১৭ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ১৬টি ওয়ার্ড থেকে আদায় করা হয় ১৪ শতাংশ। ১৭ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ বা পরিচ্ছন্ন রেইট রয়েছে। আবার ১৪ শতাংশ আদায় করা ওয়ার্ডগুলো থেকে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স, ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৪ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ বা পরিচ্ছন্ন রেইট আদায় করা হয়। চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মুফিদুল আলম বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন আদায় করে ১২ শতাংশ পৌরকর। এর মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ৭ শতাংশ, আলোকায়ন রেইট ৩ শতাংশ এবং বর্জ্য অপসারণ রেইট ২ শতাংশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও ১২ শতাংশ পৌরকর আদায় করে। এর মধ্যে হোল্ডিং ট্যাক্স ৭ শতাংশ, আলোকায়ন রেইট ২ শতাংশ, বর্জ্য অপসারণ রেইট ২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যকর রয়েছে ১ শতাংশ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল হামিদ মিয়া এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেছেন।

চসিকের রাজস্ব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরে বর্তমানে সরকারিবেসরকারি এক লাখ ৯৪ হাজার ৪০৫টি হোল্ডিং আছে। এর মধ্যে সরকারি হোল্ডিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৫১৬টি। বেসরকারি হোল্ডিং আছে এক লাখ ৯২ হাজার ৮৯২টি। চলতি অর্থবছরে ৩৪৮ কোটি ৪০ লাখ ৪৮ হাজার ৭৫০ টাকা পৌরকর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে হোল্ডিং রয়েছে ৩ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫৫টি। অধিকাংশ হোল্ডিংয়ে ৬ থেকে ১২টি করে ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে গত অর্থবছরে (২০১৯২০২০) লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫২ শতাংশ পৌরকর আদায় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও (২০২০২০২১) ৩৫০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনেও ৫০ শতাংশের বেশি আদায় হয়েছে।

চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক হাসান মারুফ রুমী বলেন, ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামবাসী নাগরিক সুবিধা কম ভোগ করেন। তারপরও কর বেশি আদায় করাটা অযৌক্তিক।

সাবেক মেয়রদের বক্তব্য : চসিকের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কাজ শুরু করেছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সিটি কর্পোরেশনের কাজ না। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা বা অন্য সিটি কর্পোরেশন এসব কাজ করে না। চট্টগ্রামে বাড়তি এ কার্যক্রম পরিচালনা করায় খরচ বেড়ে গেছে। বিষয়টা অনেকটা এরকম, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে সিটি কর্পোরেশনের খরচ বেড়েছে। সেটা কাভার করতে গিয়ে পৌরকর বাড়ানো হয়েছে।

বর্ধিত পৌরকরের বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বর্ধিত যে কাজ সিটি কর্পোরেশন পরিচালনা করছে সেগুলো থেকে সরে আসতে হবে। এসব সেন্ট্রাল গভমেন্ট পরিচালনা করবে। রাজধানীতে স্কুলকলেজ আছে, কিন্তু সেগুলো তো কর্পোরেশন পরিচালনা করে না। চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমিটির মাধ্যমে বেসরকারিভাবে পরিচালনার প্রস্তাব করে তিনি বলেন, বেসরকারিভাবে পরিচালনা করা মানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া না। এগুলো থাকবেই। কিন্তু পরিচালিত হবে বেসরকারিভাবে।

সাবেক মেয়র আ..ম নাছির উদ্দীন বলেন, ঢাকায় তো প্রচুর স্থাপনা আছে। হোল্ডিং সংখ্যাও বেশি। বহুতল ভবন আছে প্রচুর। ইনকামও বেশি। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রচুর মার্কেট ও কমিউনিটি সেন্টার আছে। সেখান থেকে তাদের রাজস্ব আদায় হয়। আবার ঢাকা রাজধানী হওয়ায় এর উন্নয়ন শুধু সিটি কর্পোরেশনের ওপর নির্ভর করে না। যেমন বিমানবন্দর এলাকার যে সড়ক সেগুলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের। সেখানে তো সিটি কর্পোরেশনকে কিছু করতে হয় না। ফলে পৌরকর কম ধার্য করলেও সমস্যায় পড়ছে না।

তিনি বলেন, পৌরকর আদায়ের হার কিন্তু সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আছে। সেখানে ২৭ শতাংশ আদায় করা যাবে। তবু পুরোপুরি আদায় করে না চট্টগাম সিটি কর্পোরেশন। অথচ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। সেগুলো ঢাকায় নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে চসিকের প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। আবার ঢাকায় কিন্তু পৌরকর পরিশোধে নাগরিকদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। সেটা এখানে নেই। ঢাকায় তো সবসময় ৭০ শতাংশ আদায় হয়ে থাকে। অথচ আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন মাত্র ২৩ শতাংশ আদায় হয়েছে চট্টগ্রামে। পরে নানাভাবে মানুষকে বুঝাতে বুঝাতে সেটা সর্বশেষ ৪০ শতাংশে গেছে।

প্রশাসকের বক্তব্য : চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পৌরকর ঢাকার চেয়ে বেশি ধার্য করা হয়েছে কেন সেটা নিয়ে রাজস্ব কর্মকর্তার সঙ্গে বসব এবং আইনকানুন পর্যালোচনা করে দেখব। তবে হোল্ডিং মালিককে অবশ্যই পৌরকর পরিশোধ করতে হবে। শহরে কিন্তু সেবার পরিধি বেড়েছে। যেমন যে ১৬টি ওয়ার্ডকে ননকনর্জাভেন্সি হিসেবে পৌরকর কম আদায় করা হয় সেখানেও কিন্তু পরিচ্ছন্নকর্মীরা কাজ করেন।

কর পুনর্মূল্যায়নের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। ইতোপূর্বে যে মূল্যায়ন স্থগিত করা হয়েছে তার আলোকে সরকারি প্রতিষ্ঠান পৌরকর আদায়ের জন্য সিদ্ধান্ত চেয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখেছি। সরকারি সংস্থাগুলো থেকে পুনর্মূল্যায়িত হারে কর আদায় করলে আমাদের বাৎসরিক আয় ১৯১ কোটি টাকার বেশি বাড়বে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমবে।

তিনি বলেন, বিল না দিলে তো বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানি পাওয়া যাবে না। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন থেকে নাগরিক সেবা পেয়েও পৌরকর পরিশোধ করবে না কেন?

আইন : আদর্শ কর তফসিল ২০১৬ অনুযায়ী, সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করা যাবে। এর মধ্যে ইমরাতের (হোল্ডিং) উপর ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স, সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ আবর্জনা রেইট, সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ বিদ্যুতায়ন বা সড়কবাতি রেইট এবং সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ স্বাস্থ্য রেইট রয়েছে।

সিটি কর্পোরেশন (কর) বিধি ১৯৮৬এর ১৯, এবং ২০ বিধিমূলে সিটি কর্পোরেশনের অধিক্ষেত্রে ভূমি ও ইমরাতসমূহের বার্ষিক মূল্য নির্ধারণের (অ্যাসেসমেন্ট) বিধান রয়েছে। উক্ত বিধিমালার বিধি ২১ অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই অ্যাসেসমেন্ট হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

আদর্শ কর তফসিল, ২০১৬ অনুযায়ী অ্যাসেসমেন্টের ভিত্তিতেই হোল্ডিং ট্যাক্স অন্যান্য ফিসমূহ আরোপ করা হয়ে থাকে, যা সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আয়ের প্রদান উৎস। ফলে নিয়মিত অ্যাসেসমেন্টে সিটি কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা ও স্বনির্ভরতা অর্জন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।’

বিধি ১৯এ বলা হয়েছে, ভবন ও ভূমির উপর কর এবং বিদ্যুতায়ন রেইট এবং আবর্জনা অপসারণ রেইট আদায় করতে পারবে কর্পোরেশন। বিধি ২০এ বলা হয়েছে, ‘বাৎসরিক মোট ভাড়া হতে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুই মাসের ভাড়া বাদ দিয়ে বার্ষিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। ভবন নির্মাণ বা ক্রয় করার সময় সরকার, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, তফসিলি ব্যাংক বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণ করা হলে উক্ত ঋণের সুদ বাৎসরিক মূল্য হতে বাদ যাবে’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআইন সংশোধন করে চসিকের ক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ
পরবর্তী নিবন্ধভ্যাকসিন যেন সবার হয়