পর্যাপ্ত বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল এবং পানির গুণগত মান। এ তিনটিই হালদা নদীতে কার্প জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ হিসেবে বিবেচিত। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে এবং পাহাড়ি ঢল এলে পানিতে এক ধরনের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এ সময় নদীতে ভৌত-রাসায়নিক ফ্যাক্টরগুলো সৃষ্টি হয়। তখন ডিম আর পেটে রাখতে পারে না মা মাছ। এ সময় পানির তাপমাত্রাও মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য সহনীয় থাকে। তবে এবার হালদায় মা মাছের জন্য কাঙ্খিত পরিবেশ অনুকূলে ছিল না। ফলে গতকাল সোমবার ভোরে মা মাছ যে ডিম ছেড়েছে তা ছিল পরিমাণে কম। হালদা নদী বিশেষজ্ঞ এবং মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানা গেছে।
অতীতে দেখা গেছে, এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে উপযুক্ত তাপমাত্রা ও লবণাক্ততায় অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে ডিম ছাড়তো মা মাছ। গতকাল ডিম ছাড়ার সময় ছিল বৈশাখী পূর্ণিমার জোয়ার। তবে এ সময় পাহাড়ি ঢল বা বৃষ্টি ছিল না। যা এবার ডিম কম ছাড়ার অন্যতম কারণ।
হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার জন্য পানির সহনীয় তাপমাত্রা হচ্ছে ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ গতকাল ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া পানির সহনীয় মাত্রা পিএইচ ৭ হলেও গতকাল ছিল ৮। সবমিলিয়ে ডিম ছাড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ পাইনি মা মাছ। অবশ্য বৃষ্টি হলে পানির এ দুটো গুণগত মান স্বাভাবিক থাকতো। তবে অনুকূল পরিবেশ না থাকার পরও ডিম ছেড়েছে কীভাবে? এ প্রশ্নও করছেন অনেকে। এর উত্তরে হালদা বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, মা মাছ ম্যাচিউরড থাকায় জোয়ারের পানির অতিরিক্ত প্রবাহের কারণে ডিম ছেড়েছে মা মাছ।
এবার মা মাছ ডিম কম ছাড়ার কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া দৈনিক আজাদীকে বলেন, এবার সবকিছুই পজেটিভ ছিল। একটি মাত্র নেগেটিভ পয়েন্ট হচ্ছে, পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া। প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হলে এবং পাহাড়ি ঢল না এলে মাছ তো ডিম ছাড়বে না। দুটোর অভাব ছিল এবার।
তিনি বলেন, মাছগুলো ম্যচিউরড অবস্থায় ছিল। এদিকে পূর্ণিমার জোয়ার ছিল। প্রচণ্ড জোয়ারের পানি এসেছে। জোয়ারের পানি আসায় মা মাছ অল্প ডিম ছেড়ে দিছে। এটা স্বাভাবিক না। কিছুটা অস্বাভাবিক। তবে আরো তিনটা জো আছে। যদি স্বাভাবিক বৃষ্টি হয় এবং পাহাড়ি ঢল নামলে আশা করছি যে কোনো জো’তে আবারো ডিম ছাড়বে।
ডিম ছাড়ার জন্য অনুকূল পরিবেশ বলতে কোন দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া হয় জানতে চাইলে বলেন, পানির গুণাগুণটা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আজকে (গতকাল) পানির তাপমাত্রা খুব বেশি ছিল। পিএইচ এর মাত্রাও অধিক ছিল। তবে বৃষ্টি হলে সবগুলো নরমাল হয়ে যেতো।
অনুকূল পরিবেশের মধ্যে মা মাছের প্রটেকশন বা নিরাপত্তাও রয়েছে জানিয়ে বলেন, এ বছর সর্বোচ্চ প্রটেকশন ছিল। কর্ণফুলী-হালদার মোহনায় নৌ-পুলিশ শতভাগ প্রটেকশন নিশ্চিত করেছে। উপজেলা প্রশাসন, আইডিএফ এর স্বেচ্ছাসেবক এবং মৎস্য অধিদপ্তরের তৎপরতার কারণে মা মাছ প্রটেক্ট ছিল। এবার কেউ মা মাছ ধরেছে বা মরে গেছে এমন তথ্য আমরা পাইনি।
এবার হালদা তেমন দূষিত হয়নি জানিয়ে বলেন, এশিয়ান পেপার মিল এবং পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ। অনন্যা আবাসিক এলাকা, খন্দকিয়া খাল হয়ে যে দূষণ সেটারও হয়তো দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। সেখানে সিডিএ আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে। তাছাড়া মানিকছড়ি এলাকায় যে তামাক চাষ হতো সেটাও মোটামুটি রিমুভ করা হয়েছে। ফলে দূষণের দিক দিয়েও ভালো রেজাল্ট ছিল। কেবল প্রকৃতি বিরুপ হওয়ায় এবার ডিম কম ছেড়েছে।
তিনি বলেন, এবার হালদা নদীতে পানির তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অতীতে ২৫, ২৭, ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকতো এবং সেটাই সহনীয়। এবার যদি বৃষ্টি হতো তাপমাত্রা ডাউন হয়ে যেতো। অন্যান্য যেসব প্যারামিটার সেগুলোও অনুকূল থাকতো।
অনকূল পরিবেশ পেলে সামনেও ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে জানিয়ে এ হালদা গবেষক বলেন, আরো তিনটা জো আছে। চলমান জো ১৮ মে পর্যন্ত থাকবে। এরপর চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে একটি এবং জুন মাসেও দুটো জো আছে। এ সময়ে বৃষ্টি হলে এবং পাহাড়ি ঢল নামলে ডিম ছাড়তে পারে মা মাছ। তবে শেষ জোতে কোনো সময় যায়নি। গত বছর চতুর্থ জোতে ছেড়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী দৈনিক আজাদীকে বলেন, এবার আবহাওয়া প্রতিকূল ছিল না। প্রচন্ড রোদ ছিল। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি এবং ঢলও নাই। আবহাওয়া তো ঠান্ডায় হচ্ছে না। যে গরম পড়ছে তা মা মাছের জন্য ডিম ছাড়ার মতো অনুকূল না। পাহাড়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে যে ঢলটা আসে তা মাছের ডিম দেয়ার জন্য সহায়ক।
এ মুহূর্তে হালদা দূষণ অনেক নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, রুই জাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশ একদমই নাই। গত দুই বছরও পরিবেশ অনেকটা একই ছিল। এর মধ্যেও ২০২০ সালে ডিম বেশি দিয়েছিল। সেটা আল্লাহর রহমত হতে পারে। গত বছর ইয়াসের (ঘূর্ণিঝড়) জন্য সমস্যায় পড়েছিলাম।
তিনি বলেন, আরো তিনটা জো আছে। তাই আমরা অপেক্ষা করবো। ইনশাল্লাহ তখন হয়তো পাবো। আকেটা বিষয়, বজ্রসহ বৃষ্টি হলে মাছ উজানে যাবে এবং একসময় ডিম দেয়। এবার নদীতে এ পরিবেশটাই ছিল না। পরিবেশ যদি একটু অনুকূলে আসে তাহলে আশা করছি আবার ডিম দিবে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালেও বৈরী পরিবেশ ছিল হালদায়। সেবারও কম ডিম ছেড়েছে মা মাছ। ওই বছরও প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ায় পাহাড়ি ঢল ছিল না। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জেয়ারের সময় অতিরিক্ত লবণাক্ততা পানি ডুকে পড়ে হালদায়। লবণাক্ততা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭২ গুণ বেশি ছিল গতবার।