হয় আত্মহত্যা, নয়তো খুন; এ দুটির যেকোনো একটি বেছে নিতে হতো বিথী দেবনাথকে। কারণ অন্যের ঘরণী হয়েও পরকীয়ার সর্বনাশা ফাঁদে পা দিয়েছেন তিনি। যার কিছু তথ্য প্রমাণ স্বামীর হাতে, ননদের হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রথমে আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেন। পরে ভেবে দেখেন, তাতে প্রমাণগুলো কি মুছে যাবে? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাকে ফাঁদে ফেলেছে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই কেবল এ যন্ত্রণার অবসান হবে।
নগরীর টেরীবাজার আফিমের গলি এলাকায় আত্মীয়ের বাসা থেকে মাধব দেবনাথ নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। অন্য কেউ নয়, মামাতো ভাই পিন্টু দেবনাথের স্ত্রী বিথী দেবনাথই তাকে কৌশলে শ্বাসরোধ করে খুন করেছেন। টানা দুদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর অবশেষে শনিবার রাতে কোতোয়ালী থানা পুলিশের কাছে বিথী স্বীকার করেন, গত ২ ডিসেম্বর তিনি একাই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহানের আদালতে গতকাল রোববার বিকাল তিনটা ২০ মিনিটে দেওয়া স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতেও তিনি অকপটে পুরো ঘটনা স্বীকার করেন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। ওসি বলেন, বিথীর মতো নার্ভ শক্ত নারী পেশাগত জীবনে খুব কমই দেখেছি। ৪ ডিসেম্বর লাশ উদ্ধারের পর ওই পরিবারের কর্তা পিন্টু দেবনাথ, তার স্ত্রী বিথী দেবনাথ, পিন্টুর দুই ভাই ও তার মা-বাবাসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়। সেদিন রাত থেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।
তিনি বলেন, অন্যদের মতো বিথীও নির্বিকারভাবে বলছিল, এ ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ডিসি মেহেদী হাসান স্যার, এডিসি পলাশ স্যার, এসি নোবেল চাকমা স্যারসহ আমরা নির্ঘুম অবস্থায় শনিবারও জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত শনিবার রাতে বিথী স্বীকার করে সে-ই অপরাধী। খুনের কারণও জানিয়েছে আমাদের। রোববার আদালতে জবানবন্দি শেষে আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
ওসি বলেন, এ ঘটনাটি আমাদের পারিবারিক অনুশাসনের অভাব আর সামাজিক অবক্ষয়ের একটি দৃষ্টান্ত। এই একটি ঘটনায় বলতে গেলে দুটো জীবনের পাশাপাশি তিনটি পরিবারও তছনছ হয়ে গেল।
আদালত ও থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিথীর সাথে পিন্টু দেবনাথের বিয়ে হয় ২০১৮ সালের মার্চে। তখন তারা নগরীর আসকার দিঘির পাড় এলাকায় থাকতেন। স্বামী পিন্টু দেবনাথ হাজারি গলির স্বর্ণকার। মাধব দেবনাথ তার স্বামী পিন্টুর পিসতুতো (ফুফাতো) ভাই। তিনি পিন্টুর বাসায় এসে দুই বেলা খেতেন অর্থের বিনিময়ে। যাওয়া-আসার মাঝে বৌদি আর দেবরের মধ্যে ঠাট্টা তামাশা চলত। চলত ম্যাসেজ আদান প্রদান। এভাবেই দুজনের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বাসায় আসা-যাওয়া ছিল বলে মাধব জানত কখন বাসা ফাঁকা থাকে। এরই মধ্যে দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সারা দেশে লকডাউন হলে মাধব মার্চের ২৭ তারিখ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় চলে যান। এরই মধ্যে মে মাসে বিথীরা টেরীবাজার আফিমের গলিতে বাসা ভাড়া নেন। মাধব গ্রামে থাকা অবস্থায় স্বামী পিন্টু দেবনাথের মোবাইল থেকে ভিডিও কলে কথা চলত দুজনের মধ্যে। চলত ছবি আদান প্রদান। পরে তা ডিলিট করে দিতেন বিথী।
নতুন বাসায় ওঠার এক থেকে দেড় মাস পর মাধব চট্টগ্রাম আসেন। পূর্বের মতো দুই বেলা খাওয়ার খরচ দিয়ে পিন্টুদের বাসায় খাবার খেয়ে আসতেন। মাধবের থেকে পিন্টু ১০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। ধারের টাকা নিয়ে মামাতো ও পিসতুতো ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। মাধবকে ওই টাকা পরিশোধ করেন পিন্টু এবং বাসায় যেতে নিষেধ করেন।
বাসায় না এলেও মাধব বিভিন্নভাবে বিথীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এর মধ্যে আগস্টে বিথী তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। মাধব তা জানতে পেরে বিথীর ভাইয়ের মোবাইলে ফোন দিয়ে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। স্বামী পিন্টুর সাথে মনোমালিন্য হওয়ার পর থেকে বিথী মাধবকে এড়িয়ে চলত। তাই বাপের বাড়ি থাকা অবস্থায় বিভিন্নভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেও সফল হননি মাধব। এর মধ্যে একদিন মাধব খবর পাঠান, তার কাছে দুজনের এমন কিছু গোপন কথা ও দৃশ্য ধারণ করা আছে, যা তিনি ছড়িয়ে দেবেন।
বিথী তাকে কাকুতি মিনতি করে বলেন, চট্টগ্রামে এসে তিনি সামনাসামনি কথা বলবেন। কিন্তু চট্টগ্রামে ফিরে এলেও বিভিন্ন কারণে তিনি মাধবের সাথে কথা বলতে পারেননি। এতে ক্ষিপ্ত হন মাধব। বিথীর ননদকে জানিয়ে দেন তার কাছে থাকা দুজনের ভিডিওর কথা। নভেম্বর মাসে কালি পূজার দুদিন আগে একটা ফেইক আইডি থেকে স্বামী পিন্টুর কাছে ভিডিও পাঠান মাধব। শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি। বিথী জানান, এ সময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু তাতে কি বদনাম ঘুচবে? তাই ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। কিন্তু এর শেষ হতে পারে দ্বিতীয় উপায়ে; যদি তাকে সরিয়ে দিই।
বিথী স্বীকারোক্তিতে জানান, ২১ নভেম্বর তাকে দেখা করতে বলি আমার সাথে। সে সুযোগ বুঝে বাসায় আসবে বলে জানায়। ২ ডিসেম্বর টেরীবাজার এলাকায় আগুন লাগার ঘটনায় কারেন্ট চলে যায়। স্বামী পিন্টু ছিলেন হাজারি গলি। দুই দেবর অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ শুনে সেখানে যান। ঘরে বিথী ও তার শাশুড়ি ছাড়া কেউ ছিলেন না, দরজা খোলা ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ দেখি আমার বেডরুমে মাধব দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ি রাতের খাবার খেতে ডাকছিলেন। মাধবের চাপাচাপির জন্য যেতে পারছিলেন না বিথী। পুনরায় ভিডিও ইউটিউবে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন মাধব। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই আর কোনো উপায় নেই, যা করার আজই করব। ভিডিওটি মুছে দিতে হলে মাধবকে সরিয়ে দিতেই হবে। কিন্তু একা তার পক্ষে সম্ভব নয় ভেবে কৌশলের আশ্রয় নেন বিথী। শারীরিক সম্পর্কের নাটকের কৌশলে খুন করেন মাধবকে।
মাধবের মোবাইল ফোন তখন বিথীর কাছে। লক খুলতে পারছিলেন না। পরে সিম খুলে সেটা নিজের মোবাইলে ঢুকিয়ে মেসেজ পাঠান মাধবের বন্ধু সুজিত, স্বামী পিন্টু ও ননদের স্বামীর কাছে। মেসেজে লেখা ছিল, ‘বৌদির সম্পর্কে যা বলেছি সব মিথ্যে। আমি মারা গেলে কেউ দায়ী থাকবে না।’ যেন সবাই বুঝতে পারে মেসেজ মাধবই পাঠিয়েছেন। মাধবের মোবাইল ফোনটি ফেলে দেন ডাস্টবিনে। এর মধ্যে মাধবের ভাতিজা ফোন দিতে থাকেন। বিথী তাকে ফোন দিয়ে জানান, সে ভালো আছে।
৪ ডিসেম্বর বিথীর শাশুড়ি তার রুমে আসে। রুম থেকে পচা গন্ধ কিসের জানতে চাইলে বিথী জানান, ইঁদুর মরেছে হয়তো। রাতে স্বামী এসেও গন্ধ পান। গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে খাটের নিচে কিছু একটা দেখে চমকে উঠেন। একপর্যায়ে জানাজানি হয় সেটা মাধবের লাশ। পুলিশ আলামতসমূহ জব্দ করেছে।