সবচেয়ে সৌভাগ্যবান তারাই যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারে। এই দুনিয়ায় তাদের যেমন কোনো ভয় নেই আখিরাতেও তারা হবে বিরল সম্মানের অধিকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন এবং নি:সন্দেহে আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী। (সূরা কলম: ৪) পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার বন্ধুদের জন্য কোনো ভয় থাকবে না সেদিন তারা চিন্তিতও হবে না তাদের জন্য দুনিয়ার জীবনে যেমন সুসংবাদ রয়েছে তেমনি পরকালেও তাদের জন্য সুসংবাদ থাকবে। (সুরা ইউনুস : আয়াত : ৬২–৬৪)
বান্দা হিসেবে আপনার কর্তব্য হবে যখনই আপনি বুঝতে পারলেন আপনার দ্বারা কোনো পাপের কাজ সংঘটিত হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে তাওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসতে হবে। আপনার এই তওবা যদি অনুতপ্তের তওবা হয়ে থাকে আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে দিয়ে মাসুম বানিয়ে নেবেন। আপনার এই বস্তুনিষ্ঠ তওবা চাওয়ার কারণে পাপ আপনার আমল থেকে ঝরে পড়বে। যখন পাপের পাল্লা আপনার থেকে হালকা হয়ে যাবে আপনি আল্লাহতায়ালার কাছের মানুষে পরিণত হবেন। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তার শরীরে। তবে তার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য হলো তার চরিত্র বা আচার ব্যবহারে। শুধু চেহারার রূপ–লাবণ্যে মানুষ কখনো শ্রেষ্ঠ হতে পারে না। যার আখলাক বা স্বভাব চরিত্র যত উন্নত ও অমায়িক সেই আল্লাহর কাছে এবং দুনিয়ার মানুষের কাছে তত সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র। হজরত উসামা ইবনুল শারিক (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমরা নবী করিম (সা.) এর কাছে এমনভাবে বসেছিলাম মনে হয় আমাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। আমাদের কেউই কোনো কথা বলছিল না। হঠাৎ কিছু মানুষ এলো এবং বলল আল্লাহর কাছে কোন বান্দা সবচেয়ে প্রিয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে সবচেয়ে বেশি চরিত্রবান (সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় বান্দা)। আল্লাহতাআলা তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে কোরআনে পাকে ঘোষণা করেন (হে রাসুল!) আপনি বলুন তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমার (প্রিয় নবীর) অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। মূলত আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা আল–ইমরান : আয়াত ৩১) আল্লাহ যে বান্দাকে ভালোবাসেন সে সংবাদ তিনি ফেরেশতাদের মাধ্যমে সারা জাহানে জানিয়ে দেন। দুনিয়াতে তাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এরপর আল্লাহতাআলা তার প্রিয় বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। যখন কোনো মানুষ আল্লাহর ভালোবাস পেয়ে ক্ষমাপ্রাপ্ত হন তখনই মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি পেয়ে ধন্য হন। দুনিয়ার নিয়ম হলো কারও ভালোবাসা পেতে হলে প্রিয় মানুষের কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয়। সুতরাং আল্লাহর ভালোবাসার পাত্র হতে হলে তার পছন্দের বিশেষ গুণাবলির অধিকারী হতে হবে। আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) নির্দেশিত পথে জীবন অতিবাহিত করতে হবে। মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করার পাশাপাশি তওবা ইস্তিগফার করতে হবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি আল্লাহর কসম! আমি দিনে সত্তরবারের অধিক আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তার কাছে তওবা করি।
কিয়ামুল লাইল রাত জেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামাজ মুমিনের মর্যাদার সিঁড়ি। জান্নাতের যাওয়ার অন্যতম উপায়। সফলতার চাবিকাঠি। আল্লাহর একান্ত ও প্রিয় হওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও তাহাজ্জুদ ছাড়েননি। ছুটে গেলে কাযা করতেন। নিজে আদায় করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উৎসাহিত করতেন। আমরা সবাই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাই। সেটা হতে হলে আমাদের আল্লাহর পছন্দের কাজ করতে হবে। আল্লাহর কাছে পছন্দের কাজ কী তা জানা যায় বুখারি শরিফের হাদিসে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) কাছ থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন আমি নবী (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম আল্লাহর কাছে কোন কাজ সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়? রাসুল (সা.) বললেন সময়মতো নামাজ আদায় করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) জিজ্ঞেস করলেন তারপর কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন বাবা মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) জিজ্ঞেস করলেন এরপর? রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বললেন নবী (সা.) এগুলো সম্পর্কেই আমাকে বলেছেন। আমি রাসুল (সা.) আরও বেশি প্রশ্ন করলে রাসুল (সা.) আমাকে আরও জানাতেন। হাদিসে মানুষের সৎ স্বভাব সম্পর্কে নানা গুণের কথা বলা হয়েছে।
মুমিনের মর্যাদার সোপান: হজরত জিবরীল (আ.) আল্লাহর হুকুমে নবীজির খেদমতে আসতেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মাঝে ওহীর জ্ঞান ও ঊর্ধ্বজগতের খবর পৌঁছানোর গুরু দায়িত্বটা ন্যস্ত ছিল তাঁর কাঁধে। নবীজীর কাছে আসতেন এবং কিছু উপদেশ ও নসীহত শুনিয়ে আবার সরে যেতেন মানব পরিবেশ থেকে। একদিন উপদেশ শোনানোর পর তিনি নবীজীকে একটি অসাধারণ দর্শন জানালেন: হে মুহাম্মাদ! মুমিনের মর্যাদা কিয়ামুল লাইল–রাতে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় ও বিভিন্ন বন্দেগীর মধ্যে আর তাঁর সম্মান মানুষ থেকে অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে। মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা অতি প্রশংসনীয় গুণ। একটু হাসিমুখে কথা বলা। ঝগড়াঝাটি এড়িয়ে চলা। এগুলো খুবই দামি আমল। বাহ্যত হালকা মনে হলেও হাশরের ময়দানে আমলের বাটখারায় তা খুবই ওজন হবে। হজরত আবু দারদা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে মিজানে (কিয়ামত দিবসে পাপ–পুণ্য মাপার পাল্লায়) সর্বাপেক্ষা ভারী বস্ত হলো উত্তম চরিত্র। পবিত্র কোরআনে অল্লাহতায়ালা বলেন যে ব্যক্তি তার জুলুমের পর আল্লাহতায়ালার কাছে তাওবা করে আর নিজেকে শুধরে নেবে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তার প্রতি দয়া করবেন নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অতীব ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সুরা মায়েদা : আয়াত: ৩৯)। এ সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন আদম সন্তান সবাই অপরাধ করে। অপরাধীদের মধ্যে উত্তম তারাই যারা তওবা করে। যে গুণ মানুষকে সম্মানিত করে যে স্বভাব আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে সহায়তা করে যে অভ্যাসগুলো মানুষের ব্যক্তিত্বকে গঠন করে যে বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ গুনাহমুক্ত জীবন গড়তে পারে যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে ঈমানের হাওয়ায় উড়তে পারেও তা নিয়ে নিচের আয়োজন :- ০১. আল্লাহকে ভালোবাসা ২. তাওবা করা ৩. বিপদে ধৈর্য ধারণ করা ৪. আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকা ৫. আল্লাহর নিয়ামতে কৃতজ্ঞ থাকা ৬. আশা ও ভয়ের মাঝে ভারসাম্য থাকা ৭. দুনিয়া বিমুখ থাকা ৮. প্রতিটি আমলে ইখলাস থাকা ০৯. বিনয়ী হওয়া ১০. সৃষ্টিজীবের প্রতি সদাচরণ করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন–হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ দ্বীন থেকে ফিরে গেলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন এক সম্প্রদায় আনবেন যাদের তিনি ভালোবাসবেন এবং যারা তাকে ভালোবাসবে ; তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে ; তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না ; এটি আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছে তাকে তিনি তা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা আল–মায়িদা : ৫৪)। সুতরাং মুমিন মুসলমানের জন্য কোনো হতাশা নয় ছোট্ট একটি সহজ আমলেই বান্দা হয়ে যাবে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। আর তাতেই রয়েছে বান্দার দুনিয়া ও পরকালের মুক্তি ও সফলতা।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট