ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হাজিরা শেষে দুই জঙ্গিকে স্বল্প দূরত্বের আরেক ভবনে স্থাপিত হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল হাঁটিয়ে, সঙ্গে ছিলেন এক পুলিশ সদস্য। তারা আদালতের মূল ফটকে পৌঁছাতেই আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা জঙ্গিদের সহযোগীরা পুলিশ সদস্যের মুখে স্প্রে করে, আক্রমণ চালায়।
হঠাৎ আক্রমণে ওই পুলিশ সদস্য অজ্ঞান হয়ে গেলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই জঙ্গিকে নিয়ে সঙ্গীরা ফটক পেরিয়ে জনসন রোডে নেমে পড়ে। দৌড়ে সড়ক পার হয়ে তারা আদালতের উল্টো দিকের গলি রঘুনাথ দাস লেইনে ঢুকে যায়।
গতকাল দুপুরে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার সময় সঙ্গে থাকা পুলিশ সদস্য নূরে আজাদের মুখে রাসায়নিক কিছু স্প্রে করা ছাড়াও মারধর করা হয়। জঙ্গিদের সহযোগীরা তাকে মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করায় তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। এ সময় একই মামলায় অন্য আসামিদেরও হাজতখানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন আরও পুলিশ সদস্য। খবর বিডিনিউজের।
গোয়েন্দাদের একজন জানান, দুজন দুজন করে আসামিকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। প্রতি দুজনের সঙ্গে ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল।
আসামির পালিয়ে যাওয়ার হট্টগোলের মধ্যে জঙ্গিদের দলটির পেছনে এক পুলিশ সদস্যকেও দৌড়ে সেই লেইনে ঢুকতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গলিতে এগিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের মারধরের শিকার হয়ে রক্তাক্ত সেই পুলিশ সদস্যকে ফিরে আসতে দেখার কথাও জানান প্রত্যক্ষদর্শী এক দোকানদার।
ঘটনার পর পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদালত চত্বর থেকে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবকে একটি মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। দুই জঙ্গিসহ একটি মোটরসাইকেলে তিনজনকে ওই সময় নাসির উদ্দিন সরদার লেইন দিয়ে চলে যাওয়ার একটি ভিডিও দেখা গেছে সংবাদমাধ্যমে।
পুলিশের বিশেষ ইউনিট কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) সেই ভিডিও বিশ্লেষণ করছে। আদালতের মূল ফটকের উল্টোদিকের সরু রঘুদাস লেইন গিয়ে মিশেছে নাসিরউদ্দিন সরদার লেইন। যে সরু গলি ধরে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা সেই রঘুনাথ দাস লেইনের শেষ মাথায় রায়সাহেব বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ফুটেজে দেখা যায় একটি মোটরসাইকেলে তিনজন অর্থাৎ ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি আর চালক ওই মোটরসাইকেল ব্যবহার করে পালিয়ে যায়। এ সময় মোটরসাইকেলের আশপাশে আরও কয়েকজনকে দেখা গেছে। তিনি জানান, রঘুনাথ দাস লেইনের কাছে আরেকটি মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যায় জঙ্গিরা।
ওই কর্মকর্তা জানান, ঢাকা মেট্রো ল ৩১-৫৭১০ নম্বরের মোটরসাইকেলটি রেখে গেছে জঙ্গিরা আর সাইকেলটির নম্বর ধরে সার্চ করলে নিবন্ধনে হাসান আল মামুনের নাম আসে। ঠিকানা হিসেবে ফায়দাবাদ ব্যবহার করা হয়েছে। মোবাইল নম্বর থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায়নি।
তিনি জানান, সে সময় মইনুল হাসান ও আবু সিদ্দিকের সঙ্গে আরাফাত রহমান ও সবুর নামে আরও দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও সফল হতে পারেননি জঙ্গিরা।
ঢাকা সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির জানান, মোহাম্মদপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায শুনানির জন্য তাদেরকে হাজির করা হয়। এ মামলায় গতকাল ১২ জন আসামিকে আদালতে তোলা হয়েছিল। দিনের শুনানি শেষে তাদের ট্রাইব্যুনাল থেকে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল; যাদের মধ্যে এ মামলার আরও দুই আসামি দীপন হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুস সবুর ওরফে আবদুস সামাদ এবং অভিজিত হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস ছিলেন। তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হলেও তাতে সফল হননি জঙ্গিরা।
ট্রাইব্যুনাল থেকে যে পথে হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল সেটির দূরত্ব ৫০ গজের মতো। দুই জঙ্গিকে নিয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের ফটকের সামনে আসতেই ঘটে হামলার এ ঘটনা। সিটিটিসির ওই কর্মকর্তা জানান, সেখানেই ওঁত পেতে ছিল সহযোগীরা। আগে থেকে পরিকল্পনা করেই ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে জঙ্গিকে। তাদের সঙ্গে কারা ছিল তা বুঝতে আরও কিছু সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
রঘুনাথ দাস লেইনের পথটুকু দৌড়ে এসে নাসিরউদ্দিন সরদার লেইনের সড়ক ধরেই মোটরসাইকেলে তারা পালিয়ে যায়। এ সড়কের একটু দূরেই ধোলাইখাল, সে পথ ধরেই জঙ্গিরা পালিয়ে যায় বলে ধারণা গোয়েন্দাদের।
আদালত প্রাঙ্গণের উল্টো দিকে রঘুনাথ লেইনের জাকির ফার্মেসির কর্মচারী জানান, দোকানের সামনে দিয়ে ৭/৮ জনকে দৌড়ে যেতে দেখেছেন এবং তাদের পেছনে এক পুলিশ সদস্যকে রক্তাক্ত অবস্থায় যেতে দেখলেও কিছুক্ষণ পর সেই পুলিশ সদস্য ফিরে আসেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এদিন বিকালে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, পুলিশ ঘটনার তদন্ত করছে এবং এ ঘটনায় দুজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। যাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদেরকে ধরতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে।
নাকে-মুখে আঘাত করা হয় কনস্টেবল আজাদকে : আদালতে জঙ্গিদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্য নূরে আজাদকে চোখে স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে মারধর করেছে জঙ্গিরা। নাকে-মুখে আঘাত নিয়ে ৩৯ বছর বয়স্ক নুরে আজাদ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।