মানব সমাজ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল, নিরাপত্তা ও জীবন ধারণের সহজিকরণ করা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ সংঘবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করে, যার ফলে সমাজের সূচনা ঘটে। আদি সমাজ ছিল শিকার ও সমাবেশকেন্দ্রিক। এরপর উদ্যান কেন্দ্রিক সমাজ ও কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা দেখা যায়। পরের ধাপে আসে শিল্পনির্ভর সমাজ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাবেই ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটে। পূর্বের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের সকল রীতিনীতি ভেঙে পড়ে এবং নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। শিল্পোন্নত সমাজে প্রযুক্তি চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছে যায়, ফলে সামাজিক কাঠামো এবং মানুষের জীবনধারা পূর্বের চেয়ে উন্নত এবং জটিল আকার ধারণ করে।
শিল্প বিপ্লবেরও কয়েক ধাপ পার হয়ে গেছে। এই সময়ে এসে আমরা এর নাম দিচ্ছি ৪র্থ শিল্প বিপ্লব, যেখানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুরন্ত রাজত্ব। এই রাজত্বের অধীনে গড়ে উঠছে নতুন সমাজ ব্যবস্থা। নাম তার স্মার্ট সোসাইটি। অভিধান বলছে, স্মার্ট মানে–উজ্জ্বল, নতুন দর্শন, পরিচ্ছন্ন, সুবেশধারী। বুদ্ধি, মেধা যার মূল অস্ত্র। এমন অস্ত্র সজ্জিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্মার্ট সোসাইটি। সমাজের সংজ্ঞায় আমরা যে একতাবদ্ধ, দলবদ্ধ শব্দগুলো শুনতাম, এই স্মার্ট সোসাইটিতেও সেগুলো প্রযোজ্য। তবে তা ভিন্নভাবে। এখানে বলা হচ্ছে, কানেক্টড বা সংযুক্ত। বিজ্ঞাপনী ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে, ‘দূরত্ব যতই হোক, কাছে থাকুন’।
আমরা জানি, ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ার একটি মিশন চলছে। সেখানের চারটি স্তম্ভও ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো–স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। বুঝাই যাচ্ছে, মিশনকে সুন্দরভাবে দাঁড় করাতে হলে স্মার্ট সোসাইটিও সুন্দরভাবে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। নইলে তা অসম্পূর্ণ দেখাবে। তবে ভালো দিক এই যে, স্মার্ট সোসাইটি গড়ে উঠছে আপন গতিতে।
একটি স্মার্ট সোসাইটি তথা স্মার্ট সমাজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষকে সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে। এটি ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে; আমাদের চাহিদা ও শক্তি সরবরাহের জন্য প্রাযুক্তিক উপায় বাতলে দেয়। সব সেক্টরে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারকে সর্বাধিক করে তোলে।
আমরা দেখেছি, করোনা মহামারিতে বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশের চেয়েও যে কম ক্ষয়ক্ষতিতে যে সুন্দরভাবে সামাল দিতে পেরেছে তার অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে দেশের সফল ডিজিটালাইজেশন। আর এখনকার যাত্রা হচ্ছে আরো স্মার্ট। স্মার্ট টেকনোলজি, স্মার্ট আ্যাপস, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এবং ইন্টারনেট অফ থিংসের ব্যবহারের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
স্মার্ট বাংলাদেশ হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ দেশের যে অঞ্চলেই বসবাস করুক না কেন, সে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা সমতার ভিত্তিতে পেতে পারবে। তখন শহর এবং গ্রামের মানুষের মধ্যে সেবা তথা সুযোগ–সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য থাকবে না। জীবনযাত্রায়ও এর ইতিবাচক প্রভাব থাকবে।
স্মার্ট সোসাইটির সব কাজ হবে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সরকার ও সমাজকে স্মার্ট করে গড়ে তোলা হবে। নাগরিকরা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবেন। উক্ত সমাজে মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই পার করতে সক্ষম হবে এবং তারা তাতেই অভ্যস্ত হবে সেটা হবে স্মার্ট সোসাইটি।
সাশ্রয়ী, টেকসই ও জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশের প্রত্যাশা দীর্ঘদিনের। যেখানে জ্ঞান, মেধা ও পরিশ্রমের জয়গান থাকবে, শোষণ ও বৈষম্যের জায়গা দখল করবে সাম্য ও স্বাধীনতা। বাংলাদেশে সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা স্মার্ট সোসাইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এখন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ঘরে ঘরে সহজলভ্য। আধুনিক ডিভাইস বর্তমানে সর্বস্তরের মানুষের নিত্যসঙ্গী। দূরশীক্ষণ, অনলাইন টউিটোরিয়াল ইত্যাদির মাধ্যমে এখন ঘরে বসইে লেখাপড়া করা সম্ভব হচ্ছে। শিল্প কারখানায় রোবট ব্যবহার করে ২৪ঘণ্টা কার্য পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া চলছে না ব্যবসা–বাণিজ্য। ই–কমার্স, ই–শপিং, ই–রিটেইলিং ইত্যাদি প্রচলিত অনেক ধারণা বদলে দিয়েছে। বিজ্ঞান ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব এনেছে এই তথ্য–প্রযুক্তি। নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির বৈপ্লবিক অবস্থানে। এসবের প্রভাব পড়েছে সমাজ ব্যবস্থায়ও।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জনাব জুনাইদ আহমেদ পলক সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘একসময় আমরা ডাক বিভাগের মাধ্যমে টাকা আদান–প্রদান করতাম। সময় লাগত ২ থেকে ৩ দিন। ২০১০ সালে ছোট আকারে যাত্রা শুরু করে বিকাশ ইনিশিয়েটিভ। মাত্র ১২ বছরের পথচলায় বিকাশ এখন বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বিকাশের মাধ্যমে শুধু কম সময়ে ও নিরাপদে টাকা আদান–প্রদানের সুন্দর সমাধান হয়েছে তা নয়, এর বদৌলতে হাজারো লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। একটি মাত্র ইনোভেটিভ এবং ক্রিয়েটিভ সলিওশান কীভাবে বৃহত্তর সমস্যার সমাধান করার পাশাপাশি বিশাল একটা জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে এটি তার উত্তম উদাহরণ।’
এমন উদাহরণ আরো তৈরি হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের জোয়ারে সয়লাব চারপাশ। আমাদের জীবনযাত্রায়ও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশ।
আমরা এই প্রাযুক্তিক জোয়ারকে গ্রহণ করতে পারি। চাইলে বর্জনও করতে পারি। তবে এড়িয়ে যেতে একদমই পারবো না। আর এভাবেই আমরা হয়ে পড়ছি স্মার্ট সোসাইটির অংশ। এভাবেই আমাদের মাঝে গড়ে উঠছে একটি স্মার্ট সোসাইটি। সার্বক্ষণিক সংযুক্তির সুবিধা, নির্ভুল ডাটাবেইস, সহজলভ্য তথ্য প্রযুক্তি, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, টেকসই অগ্রযাত্রা, আমাদের স্মার্ট সোসাইটিকে পাকাপোক্ত করে তুলতে পারে। আমাদের এসব বিষয় মাথায় রেখেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সফল হয়েছে ভিশনারি পদক্ষেপের পাশাপাশি সর্বস্তুরের সকলের সফল অংশগ্রহণের কারণে। এবারের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের পথে অন্যতম স্তম্ভ স্মার্ট সোসাইটিকেও সুন্দরভাবে নির্মাণ করতে হবে। যাতে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক উদ্যোগও বড় ভূমিকা রাখবে।
লেখক: উপ–পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)