‘যেনতেনভাবে’ কাজ করে টাকা ভাগাভাগি না করতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নতুন খাল খনন প্রকল্পের ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রকল্পটি যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। আমি কিন্তু তদন্ত করাব। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি টিম আছে, ঠিকভাবে কাজ হচ্ছে কিনা তারা এসে মাঝে মাঝে দেখে যাবেন। যেনতেনভাবে কাজ করে টাকা ভাগাভাগি করে নিয়ে যাবেন, তা হবে না। মাথা-মস্তিষ্ক পরিষ্কার করে ফেলেন। অতীত যেভাবে গেছে আগামীতেও একইভাবে যাবে না। তিনি গতকাল শনিবার সকালে ‘বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন প্রকল্প’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। পূর্ব ষোলশহরের মাইজপাড়া এলাকায় এ অনুষ্ঠান হয়েছে। সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সভাপতিত্ব বিশেষ অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
এর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী পাহাড়তলীতে আমবাগান সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করেন। খাল খনন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে তিনি আন্দরকিল্লা নগর ভবনে চসিক কাউন্সিলরদের জন্য ‘সিটি কর্পোরেশন প্রশাসন অবহিতকরণ’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।
চসিকের বিভিন্ন যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, গত রাতে শুনেছি সিটি কর্পোরেশনের কোনো গাড়িতে রেজিস্ট্রেশন নেয় না। এটা কেমন কথা! সিটি কর্পোরেশন কি রাষ্ট্রের বাইরে? রাষ্ট্রের সংবিধানের ঊর্ধ্বে? কেন রেজিস্ট্রেশন থাকবে না? বলে কি, রেজিস্ট্রেশন করলে অনেক টাকা দিতে হবে। আরে সিটি কর্পোরেশন টাকা না দিলে কর্পোরেশনকে কেন মানুষ টাকা দিবে? এসব ব্যাড কালচার থাকলে হবে না।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, সবকিছু সিটি কর্পোরেশনকে করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন শহরের মালিক। সব অথরিটির সঙ্গে কো-অপারেট করতে হবে, সবাইকে নিয়ে কো-অর্ডিনেশনের মাধ্যমে একসাথে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন শহরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। মেয়র সরকারের পক্ষে, জনগণের পক্ষে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অতএব কাউন্সিলর বা অন্য জনপ্রতিনিধি যারা আছেন সবাইকে একসাথে মিলে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, বাসার সামনে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখবে কেন। এটা না করার জন্য পরিপত্র জারি করা আছে। প্রত্যেক কাউন্সিলর যদি তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে, তার অধীনে ১০টি সাব-কমিটি করতে বলা আছে। রাস্তায় বালি ফেলে রাখলে উঠায় নিয়ে আসতে হবে।
নির্ধারিত সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, উন্নয়ন কাজে প্রকৌশলীসহ যারা সম্পৃক্ত প্রত্যেককে ঠিকভাবে কাজ করতে হবে। কোথাও কোনো কাজে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। অবশ্য গুণগত মানও ঠিক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, রাস্তা একটা করতে গিয়ে শেষ করব না, এখানে বালি- ওখানে পাথর রেখে দিলাম, আর মানুষের বাড়ি বাড়ি ধুলাবালি ঢুকবে তা হতে পারে না। যেটা ধরবেন তাৎক্ষণিক শেষ করতে হবে। কোনো কাজ টাইম লাইনে শেষ না করলে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ সময় সিটি কর্পোরেশনের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, সরকারের ওপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। সারা পৃথিবীতে নিজের টাকায় সিটি কর্পোরেশন মেট্রোরেল ও বিমানবন্দর করে। তিনি বলেন, সরকার টাকা দেবে আমি করব ভাবলে হবে না। সরকারের কাছে টাকা তৈরি এবং কাজ করানোর জন্য কোনো ম্যাজিক বা যন্ত্র নাই। কাজ জনগণ করে, টাকাও জনগণ থেকে রাজস্ব আকারে সরকার গ্রহণ করে। মানুষকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আদায়ের সুযোগ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ১০ টাকা দিলে ১০ হাজার টাকার সুযোগ ভোগ করবে বোঝাতে পারলে অবশ্যই জনগণ রাজস্ব দিবে।
মন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন বলতে শুধু অর্থ বরাদ্দ নয়। বরং কতটা সুশাসন কায়েম করতে পেরেছেন, নির্বাচিত কাউন্সিলরগণ কতটুকু জনসম্পৃক্ততা বজায় রাখতে পারছেন এবং তার এলাকা কতটুকু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন, শক্তিশালী দ্বারা শক্তিহীনরা কতটুকু অত্যাচারিত না হচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করে। এ রকম গর্বিত জায়গা মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পরিণত হবে সেই প্রত্যাশা থাকা সঙ্গত। প্রধানমন্ত্রীও এ অনুধাবনে আন্তরিক। কিন্তু চট্টগ্রামে যারা বসবাস করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা আছেন তারা যদি অনুধাবন না করেন অথবা অর্পিত দায়িত্ব ওই মাত্রায় পালন না করেন তাহলে চট্টগ্রামের উন্নয়ন স্বাভাবিকভাবে ব্যাহত হবে।
তিনি বলেন, ফ্লাইওভারের নিচে জায়গা যেন বেশি অপচয় না হয়। প্রশস্ত রাখতে হবে। উপরে এবং নিচেও গাড়ি চলতে হবে। রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকতে হবে। নালা-ড্রেন সবগুলো পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। যে রাস্তা দিয়ে আমি এসেছি সেটা পরিষ্কার করলে হবে না। নাগরিকদেরও দায়িত্ব আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাস্তা ঠিকভাবে ও সময়মতো হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। না হলে অভিযোগ দেন।
কাউন্সিলরদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জনসেবার মানসিকতা নিয়ে দায়িত্ব পালনে কাউন্সিলরদের প্রতি আহ্বান জানান।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শহরে জনগণ এক কোমর পানিতে ডুবে থাকে। এখান থেকে রক্ষার জন্য প্রকল্প নেয়া হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় এসেছেন। খালের কাজ পুরাদমে শুরু হয়ে গেল। দুই বছরের মধ্যে খালের কাজ শেষ করে ফেলতে পারব। জলাবদ্ধতা নিয়ে আমরা অবর্ণনীয় কষ্ট পাচ্ছি। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আর কষ্ট পাব না।
কাউন্সিলরদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন, চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর সকল কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব প্রদান বড় কথা নয়, এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই প্রয়োজন আইনগত ক্ষমতা দেয়া। জলাবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের বাইরে থাকা খালগুলো পুনরুদ্ধার ও খননের জন্য চসিককে দায়িত্ব ও প্রকল্প না দেয়া পর্যন্ত শতভাগ জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চসিকের আয়ের পরিধি খুবই সীমিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, সীমিত সামর্থ্য দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হয়। তাই সরকারি থোক বরাদ্দ না থাকলে উন্নয়ন থেমে থাকবে। তাই সরকারকে এই বিষয়টি ভাবতে হবে। মেয়র বর্জ্য রিসাইক্লিং প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, অনেকদিন ধরে বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্প পেন্ডিং ছিল। বর্তমান মেয়র চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করি এবার নগরবাসী সুফল পাবেন। তিনি বলেন, জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব যেভাবে বাড়ছে সে তুলনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ক্ষমতা ও আর্থিক সক্ষমতার পরিধি বাড়েনি। তিনি নতুন আয়বর্ধক প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এজন্য পরিকল্পনা ও সৃজনশীলতা প্রয়োজন। প্রযুক্তি ও কৌশল উদ্ভাবনী জ্ঞান অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে প্রাণ শক্তি দিতে পারে।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্যানেল মেয়র মো. গিয়াস উদ্দিন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম. আশরাফুল আলম, ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, মো. ইসমাইল, সংরক্ষিত কাউন্সিলর আঞ্জুমান আরা, শাহিন আক্তার রোজী, চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল আলম, প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক, নির্বাহী প্রকৌশলী ফরহাদুল আলম ও আবু সিদ্দিক। উপস্থিত ছিলেন রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার ও মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ২৪ জুন ২৮৯ কোটি ৪৪ লাখ চার হাজার টাকায় বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছিল। পরবর্তীতে কাঙ্ক্ষিত বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি চসিক। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর সংশোধন করে প্রকল্পটি এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় একনেক। গত বছর ১১৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে এক হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় আবারো সংশোধনের প্রস্তাব পাঠায় চসিক। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি তৎকালীর সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন ওয়াইজ পাড়া এলাকায় স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। তবে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ শুরু করে চসিক। সর্বশেষ গতকাল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো।
এদিকে ২০১৯ সালে আমবাগানে দুই হাজার ৮৭৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রশস্ত রাস্তার উন্নয়ন কাজ সরকার ও চসিকের যৌথ অর্থায়নে ১১ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু করা হয়। রাস্তার দুপাশে তিন হাজার ৫০০ মিটার নালা, তিন হাজার ১১০ মিটার ফুটপাত ও ৩৬৫ মিটার প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। এ প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে।