সাংস্কৃতিক চর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম। সঙ্গীত মানুষের মনে সৎ সাহস যোগায়। মহান মুক্তিযুদ্ধেও সঙ্গীত মানুষকে অনুপ্রেরণা, মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ ও সাহস যুগিয়েছে। শুদ্ধ সঙ্গীত বাংলা ও বাঙালির আবহমান সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। সংস্কৃতির সাধনা মানুষের মনন ও মানসিকতাকে ঋদ্ধ করে, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের শিক্ষা দেয়। বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয় ১৭ বছর ধরে শুদ্ধ সঙ্গীত প্রসারে কাজ করে চলেছে। যেখানে সঙ্গীত আছে, সেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে। তলোয়ার দিয়ে হয়তো যুদ্ধ জয় করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতের মাধ্যমে শত্রুকে বন্ধুতে রূপান্তরিত করা যায়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে চট্টগ্রামস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের সহযোগিতায় বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয়ের আয়োজনে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী গুণী সংবর্ধনা, আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয়ের সভাপতি কৈলাশ বিহারী সেনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় উদ্বোধক ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। সংবর্ধিত অতিথি ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ রিষু তালুকদার।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, সুর সর্বত্র বিরাজমান। বিশ্বের যে কোনো দেশে সেটি যে ভাষারই হোক, যদি তার সুর তাল লয় ঠিক থাকে এবং তা যদি শ্রুতিমধুর হয়, তবে তা শুনতে ভালো লাগবেই। আমার একটি প্রিয় গান আছে, সেটি হলো, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হবে তুমি বলতো, যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!’ জীবনটা এই পথের মতো। পথ শেষ হলেই আমাদের চলে যেতে হবে। তার আগে আমরা যদি নিজের কর্মের মাধ্যমে পৃথিবীটাকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারি, তবেই এ জীবন সার্থক হবে। এছাড়া আমাদের আশেপাশে যারা আছেন, তাদের জন্য যদি কিছু করে যেতে পারি, তাতেই আত্মতৃপ্তি। বাগীশ্বরী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যতদূর জেনেছি, বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে বাগীশ্বরী বলা হয়। তাঁর আশীর্বাদে বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয় ১৭ বছর পার করেছে, এভাবেই শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা করি। এম এ মালেক বলেন, আমি বিশ্বাস করি সঙ্গীতে। সঙ্গীত হলো শ্বাশত ভাষা। সঙ্গীত এমন একটি মাধ্যম, যেটি সুখে দু:খে আপনাকে সঙ্গ দেবে। আগে সঙ্গীত ছিল শোনার। এখন সময়ের সাথে সঙ্গীতের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মনকে ছুঁইয়ে যেতে সঙ্গীতকেও সময়ের সাথে চলতে হবে। যেখানে সঙ্গীত আছে, সেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে। তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ জয় করা যায়, আর সঙ্গীতের মাধ্যমে শত্রুকে বন্ধু করা যায়।
সংবর্ধেয় অতিথি অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সুর ও সঙ্গীতের সাথে মানুষের মনোজগতের, আত্মার সম্পর্ক আছে। বাগীশ্বরী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহুল প্রচারে চর্চা অব্যাহত রেখেছে এমন একটি সময়ে যখন সুরের মূল ধারা থেকে আমরা ছিটকে পড়তে যাচ্ছি। চটুল গান শুনতে, চটুল গান গাইতে আমরা অব্যস্ত হয়ে পড়েছি। অথচ আজও আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে আবহমান বাংলা গান। লতা মুঙ্গেশকর থেকে আশা ভোঁসলে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সতীনাথ, ভূপেন হাজারিকার গানকে আমরা এখনো অতিক্রম করতে পারি নি। একাত্তরে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে যুক্তরাজ্যে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এ অংশ নিয়েছিলেন। এ কথা আমরা ভুলি কী করে? আজ শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চা যত বেশি হবে, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি চিরটাকাল আমাদের জড়িয়ে রাখবে। প্রসঙ্গক্রমে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা স্মরণ করে তিনি বলেন, দৈনিক আজাদী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেকের পিতা মোহাম্মদ আবদুল খালেক একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েও বেছে নিয়েছিলেন সংবাদপত্র প্রকাশনাকে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরদিনই অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর ৮ কলামে দৈনিক আজাদী লিড নিউজের শিরোনাম দিয়েছিল ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। পরবর্তীতে দৈনিক আজাদীর হাল ধরেছিলেন তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। রাউজানে তৎকালীন স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন অধ্যাপক খালেদ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ লালখান বাজারে এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ পাঠান, সাংসদরা যেন নিজ নিজ এলাকায় চলে যান। বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাপত্রটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন অধ্যাপক খালেদ। তাঁর মৃত্যুর পর এম এ মালেক দৈনিক আজাদীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করে চলেছেন। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির বিচার না করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণ কাজ। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে সে কাজ সম্পন্ন করছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও প্রকৃত মুক্তি আসে নি। যে চার মূলনীতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখান থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। আমাদের মধ্যে এক ধরনের হিপোক্রেসি কাজ করছে। সংবিধানে হিপোক্রেসি রেখে রাজনীতিকে হিপোক্রেসি মুক্ত করা সম্ভব নয়। আবার রাজনীতিতে হিপোক্রেসি রেখে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ গঠন সম্ভব নয়। এ থেকে উত্তরণে আজ সবারই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার সময় এসেছে। জয় আমাদের হবেই।
দুইদিন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান বাচিকশিল্পী সঞ্জয় পালের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত হয়। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন, যীশু সেন, পলাশ দে, রিমন সাহা, প্রিয়তোষ নাথ, সমীরন সেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয়ের প্রকাশনা ‘সুরপুষ্প’ প্রকাশিত হয়। শেষে একক সঙ্গীত, সমবেত সঙ্গীত, দ্বৈত সঙ্গীত, গিটার বাদন পরিবেশিত হয়। এরপর বৃন্দ আবৃত্তি- ‘মিছিলের রাজপথ’ পরিবেশিত হয়। পরিচালনা ও নির্দেশনায় ছিলেন সঞ্জয় পাল। শেষে সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি অংশগ্রহণে দলীয় নৃত্য, স্বপন বড়ুয়ার পরিচালনায় ও পটিয়া সঙ্গীত শিক্ষক ও শিল্পী কল্যাণ পরিষদের অংশগ্রহণে অলকা মজুমদারের পরিচালনায় দলীয় নৃত্য পরিবেশিত হয়। দুইদিনব্যাপী সঙ্গীতাঞ্জলি অনুষ্ঠানটি সাতটি গ্রুপে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের নামে মঞ্চে উৎসর্গ করা হয়। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন বাগীশ্বরী সঙ্গীতালয়ের অধ্যক্ষ রিষু তালুকদার। অতিথিবৃন্দকে ফুলের শুভেচ্ছা ও সম্মাননা স্মারক এবং অধ্যক্ষ রিষু তালুকাদরের সম্পাদিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ ‘শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দীপিকা’ প্রদান করা হয়।