আলাস্কা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য। নামের মধ্যেই রয়েছে বিশালতার ইঙ্গিত “আলাস্কা” শব্দের অর্থই হলো “বিশাল ভূখণ্ড”। ১৯৫৯ সালে এটি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে যুক্ত হয়। অথচ ইতিহাস বলছে, এক সময় এই অঞ্চল রাশিয়ার অধীনে ছিল। ১৮৬৭ সালে মাত্র ৭.২ মিলিয়ন ডলারে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা ক্রয় করে নেয় যা তখন অনেকের কাছেই ছিল “একটা বরফ ঢাকা অনুর্বর জমি”। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়, আলাস্কা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই নয়, তেল, গ্যাস, সোনা ও মাছের বিপুল সম্পদেও ভরপুর এক অনন্য অঞ্চল।
এই আলাস্কার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এক রহস্যময় শহর ব্যারো (বর্তমান নাম: উটকিয়াগভিক)। পৃথিবীর মানচিত্রে এই শহরকে আলাদা করে তোলে এর অনন্য এক প্রাকৃতিক ঘটনা পোলার নাইট বা মেরু রাত্রি। বছরে একবার, নভেম্বরের ১৮ তারিখে ব্যারো শহরে সূর্য অস্ত যায়, আর এরপর টানা ৬৭ দিন সূর্য আর দেখা যায় না। পুরো শহর ঢেকে যায় এক অনন্ত অন্ধকারে। আকাশে সূর্যের আলো না থাকলেও শহর থেমে যায় না; জ্বলে থাকে বৈদ্যুতিক আলো, চলে স্কুল, হাসপাতাল, দোকানপাট মানুষ বাঁচে যেন আলো না থাকাও জীবনের কোনো বাধা নয়।
এই টানা অন্ধকারের সময় জানুয়ারির ২৩ তারিখে প্রথম সূর্যের কিরণ যখন আকাশে দেখা দেয়, তখন যেন শহরের মানুষ নতুন বছরে নতুন প্রাণ পায়। শিশুরা ঘর থেকে বেরিয়ে আনন্দে উল্লাস করে, মানুষজন সূর্যের প্রথম আলোকে স্বাগত জানায় উৎসবের মতো করে। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মানুষের সহনশীলতা ও মানিয়ে নেওয়ার এক গভীর প্রতীকও বটে।
পোলার নাইটের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো পৃথিবীর অক্ষের হেলনের কারণে সূর্যের আলো মেরু অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে পারে না। ব্যারো শহর পৃথিবীর উত্তর মেরুর এত কাছাকাছি যে শীতকালে সূর্যের আলো সেই অঞ্চলে একেবারেই পড়ে না। ঠিক একইভাবে গ্রীষ্মকালে ঘটে এর বিপরীত ঘটনা মিডনাইট সান বা মধ্যরাত্রির সূর্য। তখন সূর্য টানা কয়েক সপ্তাহ অস্ত যায় না, রাতেও আকাশে সূর্যের আলো দেখা যায়। তাই ব্যারো শহরে বছরের অর্ধেক সময় যেন দিন আর রাতের ভৌগোলিক সংজ্ঞাই হারিয়ে যায়।
ব্যারো শহরের বাসিন্দারা মূলত ইনুপিয়াত (ওহঁঢ়রধঃ) নামের এক প্রাচীন ইনুইট জনগোষ্ঠীর বংশধর। তাদের জীবনযাপনও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। এই তীব্র ঠান্ডা, অন্ধকার আর তুষারাচ্ছন্ন পৃথিবীতে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পারস্পরিক বন্ধনের জোরে। শীতকালে যখন বাইরের তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, তখনও তারা সাগরে বের হয় তিমি শিকার করতে, বরফের ঘরে পরিবার নিয়ে বসে গল্প করতে, গান গাইতে যেন প্রকৃতিই তাদের জীবন, আর জীবন মানেই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই।
আজকের আধুনিক যুগে ব্যারো শহর বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছেও এক গবেষণার কেন্দ্র। মেরু অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন, গ্লেসিয়ার গলন ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পর্যবেক্ষণে এই অঞ্চলটির ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে এই অঞ্চলে বরফ দ্রুত গলছে, বদলে যাচ্ছে প্রাণীকুলের জীবনধারা, ঝুঁকিতে পড়ছে বহু স্থানীয় প্রজাতি। ফলে ব্যারো শুধু এক প্রাকৃতিক বিস্ময় নয়, বরং পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষেত্রও বটে।
পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ ব্যারো শহরকে জানে তার অদ্ভুত রাতের জন্য। কেউ বলে “শহর যে ঘুমায় না” কারণ সেখানে গ্রীষ্মে সূর্য অস্ত যায় না। আবার কেউ বলে “চিররাত্রির শহর” কারণ শীতে টানা দুই মাস সূর্যের দেখা মেলে না। এই দুই চরম অবস্থার মাঝেই বেঁচে থাকে মানুষ, যা প্রমাণ করে প্রকৃতির নিয়ম যতই কঠিন হোক, জীবনের আলো নিভে যায় না।










