যেকোনো মূল্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

শাহেদ আলী টিটু | বৃহস্পতিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৫ at ৯:৩০ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘের (এসডিজি) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দ্বিতীয়টি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ‘ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী’ গড়ে তোলা। জাতিসংঘ সমর্থিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিসের সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিশ্বের ৫৩টি দেশের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে। যাদের অনেকেই ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সরাসরি ঝুঁকিতে রয়েছে। তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়া।

গত কয়েক দশকে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি জমি হ্রাস, সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা, আমদানি নির্ভরতা ও মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। অতি দারিদ্রের হারও বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য ক্রয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এছাড়া অতি মুনাফার লোভে নামীদামী ব্রান্ডের খাদ্য পণ্য নকল ও খাদ্যে ভেজাল মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

দেশে গত কয়েক দশকে খাদ্য উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। তা সত্ত্বেও জনগণের একটি বড় অংশ এখনো পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্যের নাগালের বাইরে। টিসিবির ন্যায্যমূল্যের গাড়িগুলোতে মানুষের দীর্ঘ সারি প্রমাণ করে দেশের মানুষ কতটা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর দেয়া গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস এর এক প্রতিবেদন অনুসারে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। এই প্রতিবেদন অনুসারে শুধু খাদ্য নিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। এখনো দেশের ১০ শতাংশ মানুষ অপুষ্টির শিকার। বিগত সরকারের কৃষি পরিসংখ্যানে প্রায় বলা হতো বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ অথচ প্রতিবছর গড়পড়তা ৬০৭০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতো।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি সম্প্রতি বিশ্ব মান দিবসের এক আলোচনায় বলেছেন, বিদেশে গেলে আমরা পণ্য কেনার আগে ভাবি না এটা আসল নাকি নকল। কিন্তু দেশে পণ্য কেনার আগে আমরা ভাবি এটা আসল নাকি নকল। দেশে এমন কোন খাদ্য নেই যে নকল হয় না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যে ক্যাবল (তার) ব্যবহার করা হয় তাতে দেখা যায় এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর, চার নম্বর মানের তার আছে। সেই নকল তারে যখন বিদ্যুতের লোড নিতে না পেরে আগুন ধরে যায়। তখন সেই শিল্প প্রতিষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। ঐ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা কাজ হারান। তিনি বলেন, দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একটি হালাল পণ্যের পরীক্ষাগার আছে। আমি নিজে সেই ল্যাব পরিদর্শন করেছি। উপজেলা পর্যায়ে একটা কলেজের রসায়ন বিভাগের পরীক্ষাগারের যেমন ধুলাবালি পড়ে থাকে। সেই রকম একটা পরীক্ষাগার। সেখানে উৎপাদিত পণ্যের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করার ক্ষমতা নেই। তবে বিশ্বের হালাল পণ্যের বাজারে রপ্তানী শুরু করতে পারলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলার হালাল পণ্যের বাজারে ঢুকতে হলে হালাল পণ্য পরীক্ষা ও রিপোর্ট দেওয়ার প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইকে উন্নত, জনবল সৃষ্টি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে গ্রহণযোগ্য হালাল পণ্যের সার্টিফিকেশন বা সনদ প্রদানের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক পশ্চিমা দেশে এ ধরণের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য, প্রসাধন সামগ্রী প্রভৃতিকে হালাল পণ্য বা সেবা বলা হয়। বিশ্বের হালাল পণ্যের চাহিদা প্রায় ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের এবং ২০৩৪ সালের মধ্যে এটি ৯.৪৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৈরিপোশাকের চাহিদার চেয়েও ৩ গুণ বেশি। তৈরিপোশাকের চাহিদা ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। সম্ভাবনাময় এ ট্রিলিয়ন ডলারের হালাল পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি মাত্র বছরে ৮৪৩ মিলিয়ন ডলার। যার বেশির ভাগই কৃষি পণ্য। মুসলিম প্রধান দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হালাল পণ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওআইসিভুক্ত দেশগুলো হালাল পণ্যের প্রধান বাজার। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্ত্বেও হালাল সনদ প্রদানের জন্য একটি শক্তিশালী সংস্থার অভাবে বিশ্বব্যাপী হালাল শিল্প থেকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী হালাল শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর দখলে। বিশেষ করে ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু খাদ্যে ভেজালের কারণে আমাদের দেশের হালাল পণ্যে বিদেশী ক্রেতারা আস্থা রাখতে পারছে না।

আমাদের দেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আছে। মাঝে মাঝে তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে হোটেল রেস্তোরাঁতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পঁচা ও বাসী খাবার রান্নার জন্য জরিমানা করতে দেখা যায়। তবুও ভেজাল মুক্ত খাদ্যের বাজার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ভেজাল পণ্য তৈরি ও বিপণনের ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। শাস্তির বিধান আরও বৃদ্ধি করে যদি নিরাপদ খাদ্য পণ্য নিশ্চিত করা যায় তাহলে তাই করতে হবে। এসব ভেজাল খাদ্যের কারণে বড়রা শুধু নয় শিশুরাও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এসবের ফলে দীর্ঘমেয়াদী কিডনি সমস্যা, স্নায়বিক সমস্যা এবং ক্যান্সারের মত মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে মানুষ। মাঠ পর্যায়ের কৃষকরাও এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে থাকে। পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেই কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগ করে। কোন কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ না নিয়েই তারা নিজেরা সেটা নিবারণের চেষ্টা করে। সাধারণত আমাদের দেশে খাদ্য দূষণ উৎপাদন পর্যায়ে ঘটে। ফল পাকানো ও সংরক্ষণের জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক এমনকি শুকনো মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুসারে দূষিত খাবারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ৪ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। একই কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বার্ষিক ১ লক্ষ ৭৫ হাজার জন মানুষ মারা যায়। বৈশ্বিক তথ্যমতে, খাদ্যবাহিত অসুস্থতার ভয়াবহতা উদ্বেগ জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমানে দেশের বিশাল খাদ্য বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের জনবল বৃদ্ধি, কর্মক্ষমতা ও নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবেলায় কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিশ্ববাজারে হালাল খাাদ্যের চাহিদা প্রতিবছর ১২ শতাংশ হারে বাড়ছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। উন্নত পরীক্ষাগার, ক্ষতিকর রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ উৎপাদন ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় কেন্দ্রিয় সার্টিফিকেশন সিস্টেম চালু করাসহ নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। হালাল শিল্পের জন্য আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা তার মধ্যে অন্যতম। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীর দেশে উত্তরণের পর শুধু পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে রপ্তানি বহুমুখীকরণের উপর জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হালাল পণ্যের বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশকে শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। প্রচুর কৃষি পণ্য, পশু সম্পদ ও মৎস্য সম্পদের অধিকারী হওয়ায় বাংলাদেশের মানসম্পন্ন এবং স্বাস্থ্যকর উৎপাদন প্রক্রিয়া বজায় রেখে বিশ্বব্যাপী হালাল বাজারে বিনিয়োগের একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব কৃষিভিত্তিক পণ্য ছাড়াও হালাল ফার্মাসিউটিক্যালস, কসমেটিক্স ও খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রযুক্তি নির্ভর কাঠামো গড়ে তোলা আবশ্যক। বিদেশীরা আমাদের দেশে উৎপাদিত পানিও পান করতে চায় না। তারা পানিকেও নিরাপদ মনে করে না। হালাল পণ্য রপ্তানি করতে হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়। হালাল পণ্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ঘাটতি রয়েছে। হালাল মাংস শুধু জবেহ পদ্ধতির বিষয় নয়। পশু লালন পালন থেকে শুরু করে পশু খাদ্য ও পরিবেশ ও সঠিক ট্রিটমেন্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আর যেকোনভাবে আমাদের কোয়ালিটি পণ্য উৎপাদন করতে হবে। এতে শুধু বিদেশে রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ হবে তা নয় দেশের স্বাস্থ্য ঝুঁঁকিও কমবে। নানা প্রকার খাদ্যবাহিত রোগ থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে। এতে বিদেশীদের আস্থা তৈরি হবে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতি। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় ভেজাল পণ্য তৈরি করে থাকে। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য আমাদের অধিকার। তাই যেকোন মূল্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : নাট্যকার, গল্পকার ; উপসচিব, সিসিসিআইএ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজোনাক হয়ে জ্বলি
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক কারেন্ট বুক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আমিন স্মরণে