যুবদলের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ গুলি, ছাত্রদল কর্মীর মৃত্যু

ব্যানার টানানো নিয়ে বাকলিয়া ঘটনা, আহত ১৫

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ব্যানার টানানোকে ঘিরে নগরে যুবদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে মো. সাজ্জাদ (২২) নামে এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। গত সোমবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে বাকলিয়া এক্সেস রোডের বগার বিল মুখ এলাকায় নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী মো. সিরাজ উল্লাহ ও যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) এমদাদুল হক বাদশার অনুসারীদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। এর মধ্যে ১২ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৭ জনের নাম জানা গেছে। এরা হলেন জুয়েল, সাব্বির, শরীফ, ইয়াসিন, একরাম, পারভেজ ও মারুফ।

বাদশার অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত সাজ্জাদ কুমিল্লার মুরাদনগর হিরাকান্দা এলাকার মো. আলমের ছেলে। তারা দীর্ঘদিন বাকলিয়া তক্তারপুল এলাকায় বসবাস করে আসছেন। তিন ভাইয়ের সবার ছোট সাজ্জাদ তিন মাস আগে বিয়ে করেছেন। আনসার ব্যাটালিয়নের প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছুদিন চাকরিও করেন। সর্বশেষ প্রবাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি চালানো শিখছিলেন বলে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

সাজ্জাদের বাবার দাবি, তার ছেলে ছাত্রদল করত। তবে নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম আজাদীকে জানান, সাজ্জাদ ছাত্রদল করত না।

এদিকে গত রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় গোলাগুলি ও নিহতের ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। হয়নি কোনো মামলা। তবে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযানিক টিম মাঠে আছে বলে জানিয়েছেন বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন। তিনি বলেন, নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এ ঘটনার জন্য বাকলিয়া থানা পুলিশকে দোষারোপ করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই। উনি রাজনীতিবিদ। উনি বলতে পারেন।

কী ঘটেছিল রাতে : পুলিশ, নিহত সাজ্জাদের পরিবার এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক এন বোরহান উদ্দীন সৈয়দ শাহ রোডে ব্যানার টানান। ব্যানারে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন ও বিএনপি নেতা গাজী সিরাজের ছবি ছিল। সোমবার দিবাগত রাতে বাদশা গ্রুপের নেতাকর্মীরা গিয়ে মেয়রের নির্দেশ রয়েছে জানিয়ে ওই ব্যানার খুলে ফেলতে বলেন এবং তারা ব্যানার নামানোর চেষ্টা করেন। এ সময় বোরহান ও তার গ্রুপের লোকজন তাদের বাধা দেন। তখন কথা কাটাকাটি হয় তাদের মধ্যে। এক পর্যায়ে বাদশা গ্রুপের কর্মীরা ব্যানারটি ছিঁড়ে ফেলেন। এতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই গ্রুপ। হয় গোলাগুলি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তারা রাতে মুহুর্মুহু গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্যানার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে জসিম নামে এক যুবদল কর্মীকে তুলে নিয়ে যান বোরহান উদ্দিন, নজরুল ইসলাম সোহেল ও তার অনুসারীরা। জসিম বাদশার অনুসারী। তাকে আটকে রেখে মারধর করা হয়। তাকে আটকে রাখার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাদশার অনুসারীরা তাকে ছাড়িয়ে আনতে যান। এ সময় বাকলিয়া এঙেস রোডে তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এ সময় ১৫ জন আহত হন। এর মধ্যে পরে আহত অবস্থায় সাজ্জাদকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক আজাদীকে জানান, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকে গুলির আঘাত ছিল। এ ঘটনায় ১২ জন চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

কী বলছেন নিহতের স্বজনরা : গতকাল দুপুরে সাজ্জাদের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, নিহত সাজ্জাদের মায়ের বুক ফাটা আহাজারি। এ সময় তিনি বলছিলেন, আমি ছেলে হত্যাকারীর ফাঁসি চাই।

নিহত সাজ্জাদের বড় ভাই ইমরান বলেন, রাত ২টার দিকে আমার মায়ের মোবাইলে একজন ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলেন। খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়ে সাজ্জাদকে মৃত দেখতে পাই। আমি রাতে বাসায় ছিলাম না। সাজ্জাদ কখন বের হয়েছে সেটা আমার মা জানেন।

সাজ্জাদের আরেক বড় ভাই মো. হানিফ বলেন, যতটুকু জেনেছি হত্যাকারীদের একজন আওয়ামী লীগের দোসর ছিল। যুবলীগের কোনো একটা পদে ছিল। আরেটা ছেলে সোহেল, তাকে আমি চিনি না। সে বর্তমানে তাঁতী লীগের পদে আছে, এটা শুনছি। আমি ভাই হত্যার বিচার চাই। এমন বিচার যেন হয়, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কোনো ভাইকে কাঁধে ভাইয়ের লাশ নিতে না হয়।

নিহত সাজ্জাদের বাবা মো. আলম বলেন, আমার ছেলে ছাত্রদল করে। আমি শ্রমিক দলের একজন সদস্য; মহানগর রিকশা শ্রমিক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। আমাদের পুরো ফ্যামিলি বিএনপির। আমার বড় ছেলে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন প্রতিনিধি। আমার ছোট ছেলে যুবদল করে।

তিনি বলেন, গাজী সিরাজের অনুসারী, তারা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগের। বোরহান উদ্দিন গুটি ব্যবসা করে, অস্ত্র ব্যবসা করে। গাজী সিরাজের অনুসারী হিসেবে সে কাজ করে। এলাকায় আগেও ঘটনা ঘটেছে, মার্ডার হয়েছে। এরপর মেয়র সাহেব ওসি সাহেবকে বলে দিয়েছিলেন তাদের ধরতে। কিন্তু ওসি তদারকি করেননি। করলে আজকে আমার ছেলে মারা যেত না।

তিনি বলেন, এখানে মেয়র সাহেবের ব্যানার লাগিয়েছে। এরা বলেছে, তুই আওয়ামী লীগ করছ, তুই কীভাবে মেয়র সাহেবের ব্যানার লাগাস? ২০/৫০ জন ছেলে গিয়ে ব্যানার নামাতে বলেছে। এরা নামায়নি। তখন ব্যানার টান দিলে তারা এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে ১০ জন আহত হয়। আমার ছেলের গায়ের গুলি লাগে।

সাজ্জাদ কী ছাত্রদলের কর্মী ছিল : নিহত সাজ্জাদের বাবা দাবি করেন, তার ছেলে ছাত্রদল করত। তবে নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম আজাদীকে জানান, সাজ্জাদ ছাত্রদল করত না।

এলাকায় সাজ্জাদের পরিচিতি ছিল এমদাদুল হক বাদশার অনুসারী হিসেবে। বাদশা জানান, সাজ্জাদ নগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জি এম সালাহ উদ্দিন আসাদের সঙ্গে ছাত্রদল করত। আসাদও স্বীকার করেন সাজ্জাদ ছাত্রদলের কর্মী। তবে নগর ছাত্রদলের আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, সাজ্জাদ ছাত্রদল করত না। সে পদবিধারী কেউ না। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আওয়ামী লীগের কয়েকটি কর্মসূচির ছবিতে সাজ্জাদকে দেখা গেছে।

ঘটনায় জড়িত হিসেবে অভিযোগ আসা নজরুল ইসলাম সোহেল গাজী সিরাজের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমদাদুল হক বাদশাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর একটি ছবিতে রয়েছেন এই সোহেল। আবার পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়ন তাঁতী লীগের সভাপতি হচ্ছেন সোহেল।

কী বলছেন সিরাজ ও বাদশা : গাজী সিরাজ আজাদীকে বলেন, আমি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করি। শাহাদাত ভাইয়ের কর্মী, বিএনপির কর্মী। আমার কোনো গ্যাং নেই। দীর্ঘদিন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলাম। দলের অনেক কর্মসূচি পালন করেছি। অনেকে এসে ছবি তুলেছেন। সবাইকে চিনিও না।

ব্যানারের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, অনেকে নানা জায়গায় নানা ব্যানার দিচ্ছে। সেখানে কে আমার ছবি দিচ্ছে, কে দিচ্ছে না সেটা কীভাবে জানব? রাজনীতি করার কারণে অনেকে আমাকে অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু তারা অন্যায় কিছু করলে তার দায়ভার আমি কেন নেব?

এমদাদুল হক বাদশা আজাদীকে বলেন, সোহেল তাঁতী লীগ করে। তারা যুবদলের নাম ভাঙিয়ে শাহাদাত ভাইয়ের ছবি দিয়ে ব্যানার লাগাচ্ছে। শাহাদাত ভাইয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা ব্যানার লাগানো যাবে না। ব্যানার খুলে ফেলতে বললে তারা গুলি করেছে। সাজ্জাদ আসাদের সাথে ছাত্রদল করত। তাকে মেরে ফেলেছে। বোরহান, সোহেল এরা জড়িত। তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর ছবিতে সোহেলের থাকা প্রসঙ্গে বলেন, মোস্তাক আমাকে ফুল দিচ্ছিল। সেখানে সোহেল ঢুকে পড়ে।

ঘটনার নেপথ্যে : বাদশা ও গাজী সিরাজ দুজন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের কর্মী। গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বোরহান ও সোহেলের সঙ্গে বাদশা ও সিরাজের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বেশ কিছুদিন ধরে এলাকার আধিপত্য নিয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১২ অক্টোবর এক গ্রুপ পিকনিকে যাওয়ার সময় বাকলিয়া কেবি কনভেনশন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে অপর গ্রুপ হামলা করে। এতে বাস ভাঙচুর করেছে একদল। এ ঘটনার পর তাদের সম্পর্ক আরো অবনতি হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকনাফে এক জালে ধরা পড়ল ৬০ মণ ইলিশ
পরবর্তী নিবন্ধলোহাগাড়ায় রাতের আঁধারে টিলা কেটে মাটি পাচার