যুবকদের ব্যক্তিত্ব গঠনে স্বামী বিবেকানন্দ

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | শুক্রবার , ১২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৫:১৪ পূর্বাহ্ণ

আজ ১২ই জানুয়ারি, যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। ১৮৬৩ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রতি বছর এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। ভারতে আজকের দিনটিকে যুবদিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দকে অনেক মানুষ আসলে শুধু একজন সন্ন্‌যাসী হিসেবে জানেন। কিন্তু এর বাইরে এসে স্বামীজির পরিচয় হলো তিনি একাধারে একজন দার্শনিক, আধ্যাত্মিক সাধক, লেখক, সমাজ সংস্কারক, মানবতাবাদী এবং সর্বোপরি যুবকদের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রেরণা দিয়ে যাওয়া একজন নেতা। স্বামীজীর মৃত্যুর পর উনাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখক বা গবেষক উনার বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন শক্তিশালী দিকগুলো উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন।

স্বামী বিবেকানন্দ এমন এক মনিষী ছিলেন যিনি দেশের সীমারেখা অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর প্রজ্ঞা, জ্ঞান, ত্যাগ ও কর্ম দ্বারা। তিনি শুধু বাঙালি জাতির জন্যই একজন মহামানব ছিলেন না, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য গৌরব বয়ে এনেছিলেন। আমরা দেখি জগতে বেশীরভাগ মানুষ সাধারণত সারাদিন নেতিবাচক চিন্তাধারায় বিভোর থাকে। তিনি আমাদের সেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পর্দা সরিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ও জীবনবোধকে জাগ্রত করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিদ্যমান। আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করে মনের পশুত্বকে সরিয়ে দেবত্বকে উন্মোচন করার আহবান করেছেন, এবং আমাদের সামনে যে আলোকময় বিশ্বব্রম্মান্ড রয়েছে তা পরিপূর্ণ উপলব্ধি করতে বলেছেন। স্বামীজীর মতে, একজন যুবক যদি নিজের ব্যক্তিত্বকে বলিষ্ঠ ও তেজস্বী করে গড়ে তুলতে চায়, তবে তাঁর সঠিক

জীবনযাপনের বিকল্প নেই। আর সে জন্য দরকার সঠিক চিন্তাভাবনার প্রয়োগ। কারণ একজন ব্যক্তির চিন্তা তাঁকে তাঁর লক্ষ্য গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এজন্য হতে হবে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী এবং আত্মনির্ভরশীল। তবেই একজন যুবক সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারবে। আত্মবিশ্বাসী ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরা যেকোনো অবস্থাতেই নিজেকে সফলভাবে তুলে ধরতে পারে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ” বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস নিজের উপর বিশ্বাস ঈশ্বরে বিশ্বাসই হলো উন্নতি লাভের একমাত্র উপায়

বিবেকানন্দ যুবকদের আহ্বান করে বলেছেন, হে যুবক ভাইয়েরা, তোমরা বিশ্বাস করো যে বড় বড় কাজ করার জন্য তোমরা জন্মেছ। ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামিও না। এক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের সাথে সাথে কঠোর পরিশ্রমেরও একটা বার্তা তিনি দিয়েছেন। ধৈর্য ও পরিশ্রম ছাড়া কোন মানুষ সাফল্য অর্জন করতে পারে না। আমরা যদি পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব জগতের ইতিহাস শুধুমাত্র কয়েকজন আত্মবিশ্বাসী মানুষের ইতিহাস। কারণ স্বামীজীর মতে প্রবল আত্মবিশ্বাসই বড় বড় কারে‌্যর জনক। কোন ব্যক্তি বা জাতি যখন আত্মবিশ্বাস হারায় তখনই তাদের বিনাশ সাধিত হয়।

স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন একজন মানুষের সাথে অপর একজন মানুষের তেমন কোন পার্থক্য নেই। আমরা সবাই সেই পরম সত্ত্বার অংশ। তবে যোগ্যতা, দক্ষতা, স্বভাব, বিচারবুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা, প্রেম, দৃষ্টিভঙ্গি এগুলোর একটা প্রভেদ চিরন্তন। এই প্রভেদগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলে তাতে একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক উন্নতি ব্যাহত হয়। স্বামীজি চাইতেন একজন মানুষ তার সহজাত প্রতিভা অনুযায়ী গড়ে উঠুক। কারণ পূর্বেই বলেছি স্বামীজি মনে করতেন মানুষ ঈশ্বরেরই অংশ। তিনি মানুষের উদ্দেশ্যে বারবার বলতেন, তোমরা অমৃতের পুত্র, তোমরা অমৃতের অধিকারী। নিজের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তাতে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারানোর সম্ভাবনা থাকে। একজন যুবককে সত্যিকার অর্থে একজন বলিষ্ঠ, তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য তিনি কতগুলো নীতির কথা বলেছেন। সেগুলো হলো আত্মশ্রদ্ধা, আত্মনিরীক্ষা, আত্মনির্ভরতা, আত্মসহায়তা, আত্মউদ্যম, আত্মপ্রয়াস, আত্মসংকল্প, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি।

প্রত্যেক মানুষেরই কিছু কাজ করার বিশেষ সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা রয়েছে, সে সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা রাখাকে আত্মশ্রদ্ধা বলে। আর আমরা দৈনন্দিন যে কাজকর্মগুলো করি সেগুলো আমাদের খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা দরকার। জীবনকে দেখতে হবে অনুভব করতে হবে এবং সচেতন হয়ে কর্ম সম্পাদন করতে হবে, এটাই আত্মনিরীক্ষা। যে কাজ আমি নিজে করতে পারি সেটা অন্যের উপর নির্ভর না করাটাই আত্মনির্ভরতা। সামর্থ্য, প্রয়োজন, উচ্চাশা এবং আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজের ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তোলাই হচ্ছে আত্মসহায়তা। চলার পথে যত বাঁধাই আসুক না কেন সেটিকে জয় করে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ায় হলো আত্মউদ্যম। আর জীবনে সাফল্যের মুখ দেখতে হলে অবশ্যই একজন মানুষকে দৃঢ়চিত্ত এবং দৃঢ়সংকল্পের অধিকারী হতে হবে। জীবনে চলার পথের বাঁধাকে অধ্যবসায় দিয়ে ডিঙ্গিয়ে যাওয়াই হল আত্মসংকল্প। আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মপ্রচেষ্টা মানুষকে পূর্ণ করে তোলে। এগুলো হচ্ছে আত্মনির্ভরতার মূলমন্ত্র। স্বামীজি বলতেন, তুমি যা চিন্তা করবে, তাই তুমি হয়ে যাবে। তুমি যদি নিজেকে দুর্বল ভাবো, তবে দুর্বল হবে। তেজস্বী ভাবলে, তেজস্বী হবে।

সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষকে কিছু না কিছু প্রতিভা দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এই প্রতিভাকে মানুষ তার বিবেক বুদ্ধি দিয়ে বিকশিত করতে পারে। আর এই বিকশিত প্রতিভাই হলো আত্মশক্তি। স্বামীজির মতে অসাধারণ প্রতিভা ছাড়াও মানুষ তার নিরলস পরিশ্রম ও প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের দ্বারা যে কোন অসাধ্য সাধন করে। আমরা দুর্বল হয়ে গেলেই ভাগ্য নির্ভর হয়ে পড়ি। একমাত্র পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনের কাঙ্খিত সাফল্য, স্থিতি ও পরিপূর্ণতা আসে। অতএব যুবকদের ভাগ্যনির্ভর না হয়ে পরিশ্রম করে যেতে হবে। তিনি বলতেন, যা কিছু মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক, মানসিক ও শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে আসে তা বিষ মনে করে স্পর্শও যেন আমরা না করি।

পরিশেষে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে স্বামীজীর একটা সুন্দর কথা আছে সেটা লিখেই শেষ করব। স্বামীজি মনে করেন বাহ্যজগতকে মানুষ বশ করে বিজ্ঞানের সাহায্য আর অন্তর জগতকে মানুষ বশীভূত করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাহায্যে। আর আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের জন্যই মুলত মানুষ ধর্মের আশ্রয় নেয়। অতএব বিজ্ঞান ও ধর্মকে সমন্বয় করতে পারলেই মানুষ শক্তিশালী হয়ে উঠবে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয়ভাবেই। বিজ্ঞান দিবে জাগতিক বিষয়কে সহজ করে আর ধর্ম দিবে নৈতিক উন্নতি। ফলে মানুষের জীবন হবে সর্বাঙ্গীন সুন্দর ও পৃথিবী হবে সমৃদ্ধ। এজন্য আমাদের দরকার সর্বজয়ী ইচ্ছাশক্তি। যুবকরা যদি স্বামীজীর এ আদর্শ গুলো মেনে চলে তবে তাদের জীবন সুন্দর হওয়ার পাশাপাশি হবে পরিপূর্ণ। পৃথিবী হবে সমৃদ্ধময়, মানুষের জীবন হবে স্বাচ্ছন্দ্যময়।

লেখক : প্রফেসর, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাক্ষেত্রে ভূমিকাভিনয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে তোলপাড়
পরবর্তী নিবন্ধমহাবিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি