একটি জাতির মূল চালিকা শক্তি হলো সে দেশের যুবক সমাজ। যে দেশের যুব সমাজ যত বেশি সুসংহত সেদেশ তত বেশি উন্নত। মীর্যা বশিরুদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘যুব শক্তির সংশোধন ব্যতিরেকে কোন জাতি উন্নতি করতে পারেনা’। একটি প্রচলিত প্রবাদ হলো, ‘বয়স্করা ইতিহাস লিখেন, কিন্তু যুব সমাজ ইতিহাস তৈরী করেন’।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশই যুবক। এ যুবক সমাজই একটি জাতিকে নতুন আলোর পথ দেখাতে পারে। যুবকরাই পারে পুরাতন সব আঁধারকে আলোর পথে নিয়ে যেতে। সুতরাং আমাদের যুব সমাজের গুরুত্ব এবং তাদের প্রতি মায়া মমতায় এবং তাদেরকে সঠিক পথে পথ দেখানোর লক্ষ্যে যিনি মাতৃস্নেহে যুব সমাজকে উৎসাহ প্রেরণা ও সাহস যুগিয়ে আসছেন তিনি হলেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২২ মে ২০২১ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ধারণকৃত এক ভিডিও বার্তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের যুব সমাজকে চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘সরকার তরুণদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণের সুযোগ দিচ্ছে। তাই চাকরির পেছনে না ছুটে মৎস্য উদ্যোক্তা হোন। এখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়ে গেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে’।
স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকীতে আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত ‘এই দেশকে আমরা সব দিক থেকে উন্নত সমৃদ্ধ করব। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলব’।
আমাদের দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ লাখ মেট্রিকটন। এখন তা ৫০ লাখ মেট্রিকটনের কাছাকাছি উৎপাদন হচ্ছে। ইলিশ মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর দেশ। মৎস্য খাতে দেশে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে। মৎস্য খাত ছাড়াও কৃষি ও ডেইরী খাতে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মৎস্য, কৃষি ও ডেইরী খাত সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগোপোযোগী উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ এগিয়ে চললেও প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। ফলে অনেকে ক্ষতি স্বীকার করেও কিছু দূর এগিয়ে গেলেও পরবর্তীতে সাহস হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের ছোবলে পড়ে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়েছে কৃষি খাত। কৃষি ও কৃষি পণ্য ধান পাটের চাষাবাদ সহ বোরো মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট চলছে। মৌসুমী ফুল, ফল, চাষী ও ব্যবসায়ীদের মৎস্য চাষ ও জেলে সম্প্রদায়, কামার, কুমার, তাঁতি সম্প্রদায়, সর্বোপরি পোল্ট্রি, ডেইরী ও প্রাণী সম্পদের খাত সারাদেশে গত দু’বছর কার্যত লকডাউনে থাকায় এবং মুজিব বর্ষ, স্বাধীনতা দিবস ও নববর্ষ সহ জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন ব্যাহত ও বিঘ্নিত হওয়ায় এসব খাতে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবারই পথে বসার উপক্রম ঘটেছে। এ মুহূর্তে সর্বাধিক বিপদে রয়েছে পোল্ট্রি ও গবাদি পশুর খামার শিল্প। ডিম ও দুধের বাজারজাত করণের সমস্যার কারণে এ দু’টি খাত এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ফীড মিল সমূহে ধ্বস নেমেছে। মুরগির বাচ্চা বিক্রি না হওয়ায় ছানাগুলো জ্যান্ত ধ্বংস করা হয়েছে। ডিমের ক্রেতা নেই বললেই চলে।
খামারিরা দুধ বিক্রি করতে না পেরে দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে। গত বারো বছরের মধ্যে গত দু’বছরে পোল্ট্রির দাম সর্বনিস্ন থাকায় এ শিল্পের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এ শিল্পে কর্মসংস্থান হয় প্রায় ৬০ লাখ লোকের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখাতের গুরুত্ব ও ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তা যথাযথভাবে বন্টন না হওয়ায় প্রান্তিক পর্যায়ে এর সুফল পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট খাতের সাথে জড়িত ব্যবসায়িরা। ব্যাংকের দায় দেনা এবং তাদের অমানবিক চাপাচাপির কারণে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা আজ পথে বসেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও উৎসাহপূর্ণ আহ্বানের প্রেক্ষিতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, কর ও শুল্ক, ভ্যাট স্থগিত রাখা সহ ফিডের কাঁচামাল আমদানির সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন বলে প্রত্যাশা করি।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আজও কৃষি এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত। কৃষি খাত বাংলাদেশের ১৬.৫ কোটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা বিধান করা ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালেরও জোগান দেয়। বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ১৩.০২ ভাগ আসে কৃষি হতে এবং এ খাতে শতকরা ৪০.০৬ ভাগ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে শুরুতেই অধিকতর মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন কৃষি ক্ষেত্রে। কৃষ্ কি্ষেত্রের গুরুত্ব ও মর্ম উপলব্ধি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কৃষক নীতিকে পুরো পুরি কৃষিবান্ধব করে সাজিয়ে ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া অনুপ্রেরণায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি সহ দেশের প্রতিটি খাতকে ঢেলে সাজিয়েছেন। উন্নয়নের সবদিক থেকে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্বপ্নের উন্নত দেশের সমমানের লক্ষ্যমাত্রা পৌঁছানোর জন্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্যের বহুমুখীকরণ এবং খোরপোষা কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর প্রয়োজন। বাণিজ্যিক কৃষির সুফল লাভের জন্য প্রয়োজন ছোট বড় কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি, কৃষি প্রক্রিয়াজাত করণ, শিল্পের বিস্তার, কৃষিপণ্য রপ্তানীর অধিকতর সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি। ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবস্থা এবং সুসংগঠিতভাবে দেশীয় বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করা, কষি বিপণন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং মণিটরিং শক্তি বৃদ্ধির প্রয়োজন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে যুব সমাজকে চাকরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তা খুবই সময়োপোযোগী বলে মনে করি। যুব সমাজ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে চাকরির পিছনে ছুটতে গিয়ে সময় শক্তি ও মনোবল সব হারিয়ে ফেলছে। এক সময় সে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বিপথে পা বাড়ায়। ফলে একটি সুন্দর জীবনের হাতছানি অকালেই ঝরে পড়ে। যে পিতা মাতা নিজেদের সবকিছু ত্যাগ করে সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে একটা পর্যায়ে নিয়ে আসে তারাও হতাশ হয়ে পড়ে। যা একটি জাতির জন্য কোন সুলক্ষণ নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাপূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে প্রথমেই। আমরা দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও পরিকল্পনাকে প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় প্রতিনিয়ত। কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দূর্বলতার কারণে একজন উৎসাহী উদ্যোক্তা শুরুতেই কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, একজন নতুন উদ্যোক্তা যাবতীয় কার্যাদি সমাপ্ত করে ব্যাংকের নিকট প্রকল্পের অর্থের জন্য গেলে প্রথমেই ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তাদেরকে নিরুৎসাহিত করে দেয়। যদি কোন সুপারিশের কারণে প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করলেও তা অপর্যাপ্ত। নতুন উদ্যোক্তা নিজস্ব সোর্স হতে অর্থের যোগান দিয়ে নতুন প্রকল্পটি উৎপাদন অবস্থায় নিয়ে গেলেও পরবর্তীতে ব্যাংকের অসহযোগিতা এবং প্রতিবন্ধকতা হরেক রকম সুদের যন্ত্রণা এবং বিশেষ করে ওয়ার্ক কিং ক্যাপিটেল বা মূলধন সরবরাহে অনীহার কারণে উদীয়মান একটি শিল্প এবং একজন উদ্যোক্তা প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে হিসেব করলে দেখা যাবে ৮০/৯০ শতাংশ নতুন উদ্যোক্তা উৎপাদনে যাওয়ার আগেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। নতুন উদ্যোক্তা তৈরীতে বাধা কোথায়? ব্যাংকিং সেক্টরের অপরিকল্পিত অসহযোগিতা এবং সুযোগ সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে যে অসামঞ্জস্য রয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। অন্যথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে সদিচ্ছা তা প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং হবে। ফলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং কৃষি বিপ্লবের যে শুভ সূচনা তা বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে যুব সমাজ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলবে। যুব সমাজকে মেরুদণ্ডহীন না করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাকে সহযোগিতা করা এখন সময়ের প্রয়োজন। আমাদের দেশের মানুষের কায়িক পরিশ্রম ও দেশের প্রতি ভালোবাসায় আজ দেশ বিশ্বে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে এগিয়ে চলেছে। সামনে আরো এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক : শিল্পশৈলী