যুদ্ধ, মাতৃত্ব ও কবিতা

দেবাশীষ মজুমদার | শুক্রবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ

নাদিয়া তুয়েনি (১৯৩৫-১৯৮৩) ছিলেন একজন লেবানিজ কবি ও সাংবাদিক, যিনি ফরাসি ভাষায় লেখালেখি করতেন এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যভুবনে এক অনন্য কণ্ঠস্বর হিসেবে বিবেচিত। তাঁর পিতা ছিলেন লেবাননের প্রখ্যাত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মিশেল চেইহা, এবং মা ছিলেন ফরাসি। এই দ্বৈত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তাঁর কাব্যচেতনাকে গঠন করে, যেখানে লেবাননের ভূখণ্ড এবং ফরাসি সাহিত্য ঐতিহ্য একসঙ্গে মিশে গেছে।

তুয়েনির জীবন ছিল বেদনাময় ও প্রতীকী-তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর অল্প বয়সী কন্যাকে হারান, যা তাঁর কবিতার ভাষায় গভীর দাগ রেখে গেছে। সাংবাদিক হিসেবে তিনি “খ’ঙৎরবহঃ-খব ঔড়ঁৎ” পত্রিকায় কাজ করতেন, কিন্তু মূলত একজন কবি হিসেবেই তাঁর পরিচয় স্থায়ী হয়েছে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:

Les Textes Blonds (1963)

La Terre Arrêtée (1971)

Archives Sentimentales dÕune Guerre au Liban (1982)

এই শেষোক্ত গ্রন্থটি, ঝবহঃরসবহঃধষ অৎপযরাবং ড়ভ ধ ডধৎ রহ খবনধহড়হ, তাঁর জীবনের শেষ দিকে লেখা এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত অবস্থায় প্রকাশিত। এটি কেবল একজন নারীর কাব্যিক আত্মপ্রকাশ নয়, বরং একটি গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের স্মৃতির দলিলও। এখানে মাতৃত্ব, মৃত্যু, দেশ, দেহ ও ভাষার মধ্যে সম্পর্ক নতুন আঙ্গিকে ধরা পড়েছে। যুদ্ধের নির্মমতা ও নারীর অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণার মেলবন্ধন এ গ্রন্থকে শুধু সাহিত্যিক নয়, রাজনৈতিক ও অস্তিত্বমূলক পাঠেও পরিণত করে।

মৃত্যু ও মাতৃত্বের সংলগ্নতা

নাদিয়া তুয়েনির “ Sentimental Archives of a War in Lebanon ” নারীর আত্মকথামূলক কাব্য, যেখানে শরীরই মানচিত্র, ক্ষতই ভূগোল। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, যখন গৃহযুদ্ধ লেবাননের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে, আর কবি নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত, মৃত্যুর মুখোমুখি। তুয়েনি তখন কেবল কবি নন, তিনি এক নারীমূর্তি, যিনি ভাষাকে প্রসব করছেন। সে ভাষা কোনো রাষ্ট্রের নয়, কোনো সমপ্রদায়ের নয়-সে ভাষা নারীদেহে জন্মায়, রক্তে ভাসে, সন্তানের মতো বেড়ে ওঠে। এই কবিতাগুলোতে তিনি নারী ও দেশের মধ্যে এক গভীর, পরিবর্তনশীল সম্পর্ক স্থাপন করেন-যেখানে নারীর শরীর ও মাতৃত্বকে তিনি লেবাননের ভূখণ্ড ও ইতিহাসের সঙ্গে মেলান। যেমন একটি পঙক্তিতে তিনি লেখেন: “আমি জিহ্বার নিচে লুকিয়ে রেখেছি এক দেশ”-যেখানে ভাষা, শরীর ও ভূমি একত্রে মিশে যায়। দেশ যেন তাঁর সন্তান-আবার তিনিই সেই সন্তানের গর্ভ।

“Femme, jÕinventerai pour toi autre chose, un autre langage. ”নারী, তোমার জন্য আমি এক নতুন ভাষা সৃষ্টি করব।”

এই উচ্চারণটি নারীর পক্ষে এক দৃঢ় ঘোষণা-তবে তা কোনো স্লোগান নয়, বরং এক গভীর আত্মপ্রকাশ। এখানে ভাষা হয়ে ওঠে এক গভীর অনুভবের আকার-যা মুখে উচ্চারিত হয় না, কিন্তু শরীর ও স্মৃতির ভেতর গেঁথে থাকে। এই ভাষা প্রতিবাদের জন্য নয়, বরং নিজেকে বোঝার, নিজের ভেতর থেকে জন্ম নেবার ভাষা। এটি এমন এক কণ্ঠস্বর, যা নীরবে ধরে রাখে ক্ষত, প্রেম, এবং প্রতিদিন নতুন করে গঠিত হওয়ার যন্ত্রণা। “আমি একটি পতাকা হয়ে উঠি, যার কোনো রঙ নেই, শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসে ভরা ফাটল, আর রাত্রির মূলে গড়িয়ে পড়া এক সাদা শব্দ: ‘স্মৃতি’।”

শরীর যেখানে দেশ, স্মৃতি যেখানে রক্ত

নাদিয়া তুয়েনি ছিলেন দ্রুজ পিতার কন্যা, ফরাসি ক্যাথলিক মায়ের সন্তান, এবং গ্রিক অর্থোডক্স স্বামীর সহচরী। জন্মেছিলেন লেবাননে, বড় হয়েছেন গ্রিসে, লেখালেখি করেছেন ফ্রান্সে। তিনি একাই ধারণ করছিলেন তিনটি ধর্ম, তিনটি জাতিসত্তা, তিনটি ভাষা-এবং একটি বিপন্ন মাতৃত্ব।“ Aussi ai-je enfermé sous ma langue un pays, gardé comme une hostie.” “আমি জিহ্বার নিচে লুকিয়ে রেখেছি এক দেশ, একটি নীরব মাতৃভূমি-যাকে ধারণ করেছি একটি পবিত্র অর্ঘ্যের মতো।”এই পঙক্তিতে ভাষা আর দেশ পৃথক নয়। ভাষা মানে শরীর, শরীর মানে দেশ, দেশ মানে এক অভ্যন্তরীণ দহন। যে জাতি তার নিজস্ব পরিচয় বারবার হত্যা করে, তার সন্তানরাও প্রতিদিন আত্মহত্যা করে। “আমি তখন সেই মেয়েটি হয়ে উঠি, যে প্রতিদিন নিজের গর্ভে জন্মায়, আর সন্ধ্যাবেলায় নিজেকেই কবর দেয়।” মাতৃত্ব এখানে কোনো আদর্শিক মহিমা নয়, এটি একটি ভাঙা ভূখণ্ডে সন্তান জন্ম দেওয়ার সাহস। “আমি আমার শরীরে রেখেছি এক গোপন কুয়ো,” -এখানে ‘কুয়ো’ একটি গভীর রূপক, যা নারীর শরীরকে স্মৃতির এক জলাধার হিসেবে দেখায়। তুয়েনির কবিতায় এই কুয়ো যেন আত্মজার স্থান, যেখানে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, মাতৃত্বের ক্ষত, এবং ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সবকিছু জমা হয় একত্রে, যেন তা ভাষার মাধ্যমে উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করছে।

“আমি আমার শরীরে রেখেছি এক গোপন কুয়ো,” যেখানে দেশের মৃত্যুর খবর পড়ে যায় প্রতিদিন। আমি সেখানে নামিয়ে দিই আমার স্তনের দুধ, জরায়ুর রক্ত, মেয়ের অন্ধকার ছবি। তারপর একদিন আমি নিজেই সেই কুয়োর ধারে দাঁড়াই, নিজেকে দেখি জলেই-এক কুয়োর ভিতর এক কবিতা, যা বলছে- আমি আর সেই আমি নই,আমি শুধু আরেকবার জন্ম নিচ্ছি।”

স্মৃতি, মৃত্যু, এবং দেশের রক্তাক্ত পুনর্জন্ম

“ Sentimental Archives ”-এর শেষে তুয়েনি দেখান কিভাবে মাতৃত্ব ও দেশপ্রেম একই শরীর থেকে জন্ম নেয়-তাঁর ভাষায়, “আমি আমার দেশকে আমার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সৃষ্টি করি।” JÕappartiens à ma folle terre: je la crée par ma mort. ” “আমি আমার উন্মাদ মাটির অন্তর্গত: আমি তাকে সৃষ্টি করি আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।” শহর তাঁর কাছে কখনো এক কবরস্থান, আবার কখনো এক গর্ভ-যেখানে কবরস্থান মানে মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও ধ্বংস, আর গর্ভ মানে সম্ভাবনা, সৃষ্টির আগমন, এবং মাতৃত্বের অন্তঃস্থ বেদনা। তুয়েনির কবিতায় এই দুই রূপ যেন লেবাননের রক্তাক্ত অতীত ও আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎকে একসাথে ধারণ করে,যেখানে বুলেটগুলো ভ্রুণের মতো বেড়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় যুদ্ধ মানে শুধু বাহ্যিক সংঘর্ষ নয়, বরং স্মৃতির বিরুদ্ধে এক অন্তরঙ্গ প্রতিরোধ। “স্মৃতিগুলো কখনো কেবল এক কন্দরের শব্দ, যেখানে প্রতিধ্বনি আসে না, কেবল ঘূর্ণি, কেবল দগ্ধ অক্ষর।” তুয়েনির কবিতা, মৃত্যু আর মাতৃত্বের মধ্যবর্তী রেখায় ধীরে ধীরে হেঁটে চলে-প্রতিটি শব্দ যেন সেই সরু সীমারেখা ধরে এগোয়, যেখানে জন্ম ও বিলুপ্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে এক নারীর অভিজ্ঞতা। এই যাত্রা শেষে সে এসে দাঁড়ায় একটি গভীর বাক্যে, যেটি কেবল একটি উপসংহার নয়, বরং একটি উত্তরাধিকার: “আমি নিজেকে রক্তে রচি, যাতে দেশ একদিন নিজেকে আমার মতো করে চিনে নিতে পারে।”

নাদিয়া তুয়েনির কাব্যভাষার জগতে প্রবেশের জন্য এখানে উপস্থাপন করছি তাঁর তিনটি কবিতা-যার প্রতিটিই তাঁর কবিচেতনার একান্ত স্বাক্ষর বহন করে। যুদ্ধ, নারীসত্তা, মাতৃত্ব ও ভাষার গভীর অনুভব এই কবিতাগুলোকে সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে পাঠকের আত্মায় পৌঁছে দেয়।

লেবানন

আমি কোনো দেশের নই

না কোনো নিশান বা সীমানার

এক ভূখণ্ডের সন্তান-যেখানে ছাইয়ের পাশে ফোটে জ্যোৎস্নার জুঁই

যে দেশে সাকিন আমার-

সেখানে একটি কবিতা পাঠের আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে

রাত্রির সূক্ষ্ম বুনন

হে রাত্রির সূক্ষ্ম বুনন,

প্রাচ্যের দিশারী যত, গুনে তোমার আদব-লেহাজ

বর্ষের আঙুলে যেন রাখে তার হিসাবভার।

হাওয়া ও তার সঙ্গীরা উন্মুক্ত হয়

একজন নারীর মতো-

নরম, ধীর, এবং রহস্যময়।

এবং প্রতিটি বস্তু যেন

একে ওপরের সাথে কথা কয়।

যে শব্দ আমি কল্পনায় শুনি-

তা কখনো নদীর ধ্বনি,

কখনো হিকমতের মতো চাপা কান্না।

হে রাত্রি, তুমি মৃত্যুর মতো নিঃশর্ত স্বাধীন-

ঠিক সেই মাহফিলে যেমন-

চোখে চোখ রেখে মানুষ বোঝে সব,

নিঃশব্দে, উচ্চারণহীন।

এইজন্যই তো্ত

আমি জিহ্বার নিচে লুকিয়ে রেখেছি এক দেশ,

একটি নীরব মাতৃভূমি-

যাকে ধারণ করেছি

একটি পবিত্র অর্ঘ্যের মতো।

নারী, তোমার জন্য

নারী-

তোমার জন্য আমি সৃষ্টি করব

নতুন কিছু-

ভিন্ন এক ভাষা,

পুনর্জন্ম-হওয়া এক জগৎ,

একটি পথ,

যার ঠিকানা নেই কোনো মানচিত্রে।

নারী-

নিদ্রিত বালুর গভীরে

আমি খুঁজে আনব

তোমার পথের চিহ্ন।

এই পৃথিবী তোমার নয়-

তুমি এখানে কেবলই আগন্তুক,

তবু নিঃশব্দ সৌম্যতায়

তুমি চেষ্টা করো মানিয়ে নিতে

এই বিসদৃশ জীবন।

নারী-

তোমার জন্য জাগুক এক স্বতন্ত্র পৃথিবী,

ধারণ করবে তোমার নাম।

নাদিয়া তুয়েনির কবিতা শুধু কোনো ব্যক্তি-ইতিহাস নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্বের অন্বেষণ। তাঁর রচনাবলী আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যুদ্ধ কখনো কেবল রাজনৈতিক নয়-তা শরীরেও ঘটে, ভাষাতেও ঘটে। Sentimental Archives of a War in Lebanon গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ, যেখানে যুদ্ধ ও নারীর অভিজ্ঞতা কাব্যিক ভাষায় গভীরভাবে ধরা পড়েছে। তবে তাঁর কবিতার বিস্তার এই একটি বইয়ের সীমা পেরিয়ে আরও ব্যাপক-যেখানে প্রতিটি কবিতা নিজেই হয়ে ওঠে স্মৃতির আশ্রয়, এক অন্তর্গত দেশ। নারীর ভাষা যেখানে অনুচ্চারিত, সেখানেই জন্ম নেয় এক নিঃস্ব দেশ-তুয়েনির কবিতা যেন সেই নীরবতার প্রতিবাদ।

“আমি যদি কিছু লিখে যাই, সে হবে আমার শরীরের ভিতর গেঁথে রাখা দেশটির নাম। বুলেট নয়, একটি শব্দই হবে আমার প্রতিরোধ।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধম্যাক্সিম গোর্কীর মা