যুদ্ধের কুয়াশা লিনসে অ্যাডারিওর সাথে কথোপকথন

অনুবাদ: সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৩১ আগস্ট, ২০২৪ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

মানুষের নিজস্ব সংকট রয়েছে এবং বাইরে কী ঘটছে তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সম্ভাবনা কম’

পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী মার্কিন ফটোসাংবাদিক লিনসে অ্যাডারিও গত ২০ বছর ধরে মানুষের মানবিক সংকট নথিভুক্ত করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। ২০০০ দশকের গোড়ার দিকে আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে শুরু করে সমপ্রতি সিরিয়া ও ইয়েমেন পর্যন্ত যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী পরিণতির ওপর আলোকপাত করে জনগণ যেভাবে সংঘাতকে দেখে তা নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু সামপ্রতিককালে তিনি নিজ দেশে পশ্চিমা সরকারগুলোর মুখোমুখি হওয়ার প্রতি গুরুত্ব অনুভব করছেন।

মানবিক সংকট ডকুমেন্টেশন করার জন্য আপনার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট কী ছিল?

২০০০ সালে তালেবানের অধীনে আফগানিস্তানের ডকুমেন্টেশন করেছিলাম এবং পরবর্তীতে ল্যান্ডমাইনের শিকার নারী ও শিকারদের ছবি তোলার জন্য তিনবার আলাদা ভ্রমণ করেছি। সেই সময়, নিশ্চিত ছিলাম না যে এটি একটি মূলত মানবিক কৃত্রিম স্পট যা নিজস্ব সৃষ্টি, কারণ সেখানে খুব কম [মানবতাবাদী] অভিনেতা ছিল। কিছু আমার সংগঠন ল্যান্ডমাইনের ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করছিল এবং অন্যরা গোপনে নারীদের দল চালাচ্ছিল, তাদের বৃত্তিমূলক দক্ষতা শেখাচ্ছিল। অনেক শিক্ষিত নারী ছিলেন যারা বন্দীগৃহে জীবন যাপন করতেন, তাই জাতিসংঘ নারীদের জন্য কর্মসূচি প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। সেই প্রথম আমি আন্তর্জাতিক মানবিক সমপ্রদায়ের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম।

যখন আপনার তোলা ছবিগুলো দেখেন, কোনো বিশেষ কিছু কি আপনাকে মুগ্ধ করে?

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমি মানুষের প্রতি কম শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। আমার সেই তারুণ্যের অনুভূতি ছিল এরকম ‘ভালোই তো, আমি আপনাকে সাহায্য করতে এখানে আছি’, এবং সেই আত্মধার্মিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক সময় ধরে। আমি সবসময় অনুমতি চেয়ে কাজ করতাম, কিন্তু এখন জানি পুরো কথোপকথ্‌েন আমাদের কতটা সংবেদনশীল হতে হবে এবং যাদের ছবি দৃশ্যমান হবে তাদের অনুমতি চাইতেও আমাদের কতটা সতর্ক হতে হবে। এও জানি না ২০ বছর ধরে আদতে এটা কতটা যৌক্তিকভাবে করা হয়েছে নাকি ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে ধরে নিতে হবে যে আমার তোলা প্রতিটি ছবি সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসবে। আফগানিস্তানে যখন তালেবানের অধীনে কাজ করতাম, তখন তারা আমাকে ছবি তুলতে দিতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল কেননা আমার আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রায় কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। আমি মনে করি কে অনুমতি দিচ্ছে, কিভাবে দিচ্ছে এবং কে নিচ্ছেন এগুলো প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন, একই গৎবাঁধা নিয়মে একে ফেলা যাবে না।

সঙ্কটে বসবাসকারী লোকেরা বরং বিষয়গুলো কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। তারা সাংবাদিকতার শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম হওয়ার ক্ষমতার প্রতি অনেক বেশি সন্দিহান। মানুষ আমেরিকাকে বিশ্ব পুলিশ এবং ত্রাণকর্তা হিসাবে দেখতে পাচ্ছে, যারা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একটি দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে। কেউ আমেরিকার দিকে ফিরে যায় না বা বিশ্বাস করে না যে সেখানে গিয়ে কিছু করবে। তারা তাদের মাথায় একদম সেট করে দিয়েছিলো, আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা আসলেই বোধহয় কোনও সমস্যা সমাধান করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, ২০ বছর আগের চেয়ে এখন তারা অনেক বেশি সংশয়বাদী।

মানবিক খাতের মধ্যে, সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যবহৃত আলোকচিত্রগুলি সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। যেখানে পূর্বে পেট ফাঁপা এবং চোখে মাছি নিয়ে একটি শিশুকে দেখানো হতো মানুষের হৃদয় নিগড়াতে এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য, আজ একই খাতে এজেন্সির লক্ষ্য পূরণেধরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, বলা যায় তারা এখন মর্যাদার সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখাতে চাইছেন। আপনি কি ফটো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পরিবর্তন দেখেছেন?

দেখুন, আমরা চেষ্টা করি মানুষকে তাদের পরিস্থিতির চেয়ে খারাপ দেখানো যেন না হোক। আমি সেনসেশনালিস্ট ফটোগ্রাফার নই। পেট ফাঁপা শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই মারাত্মক অপুষ্টির প্রতীক। মনে করি কিছু পরিস্থিতিতে এই ছবিটি তোলা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সংকটের গুরুত্ব দেখায়যেমন ক্ষরার মতো পরিস্থিতিতে। যেখানে হাজার হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে কারণ তারা খাবার পাচ্ছে না। গণ অনাহার বা দুর্ভিক্ষ [বেশি] একটি ফাঁপা পেট বা কাঁটাযুক্ত বাহু সহ একটি শিশুর চেয়ে আর কিছুই ব্যক্ত করার থাকে না। আমি দুঃখিত যদি এটি আপত্তিকর হয়, তবে এটাই বাস্তবতা।

আমি মনে করি একজন ফটোগ্রাফার হিসাবে সম্মানজনক উপায়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ, পরিবার ঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত করা, আপনজনেরা বুঝতে পেরেছেন কিনা তা নিশ্চিত করা। মানুষ সচেতন, তারা জানে সাংবাদিক কারা, তারা জানে আমরা কী করছি, তাই আমি মনে করি না যে কেউ এই ছবিটি দেখেছে এবং আপনাকে বলতে পারছেন আপনি সুবিধাভোগী, তা অন্যায় হবে। আসলে, এটা আপত্তিকর মনে হয়আপনি সেই ব্যক্তির ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন। আপনি কি জানেন, আপনার চেয়ে সেই ব্যক্তি ভালো না মন্দ? বরং যেসব ছবি বিতর্কিত, সেগুলো তোলা দরকার। যদি আমাকে শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া হয় তবে আমি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে শ্যুট করব, তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি এটি প্রকাশ করব। প্রকাশ করার অধিকার আমার নেই, যতক্ষণ না আমি অনুমতি পাচ্ছি।

আপনার ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোতে ফিরে যাই, আপনার নিজের কাজে কি তখনকার সংকটকে যেভাবে চিত্রিত করা হতো এবং বর্তমানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখতে পান?

যে পরিমাণ সংকট চলছে তাতে মানুষ আজ ক্লান্ত। আমি আসলে জানি না, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণেই বিষয়গুলো এখন আগের চেয়ে বেশি আমাদের মুখে মুখে কিনা। তবে আমাদের কাছে যে তথ্যগুলো আছে তার ভিত্তিতে বেশি চিত্রের সংস্পর্শে এসেছি। এতে মানুষ আপ্লুত বলা যায়। চলমান সংকটের নিখুঁত সংখ্যা পরিবর্তিত হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সংকটের বোমাবর্ষণের সাথে মানুষের দুর্ভোগ থেকে অনাক্রম্য হয়ে ওঠার ঝুঁকির কথা বলতে শুনেছি। মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেয় সে জন্য কী সিদ্ধান্ত নেবেন?

আমি এমনভাবে ছবি তোলার চেষ্টা করি যা মানুষকে বিমুখ না হয়ে ছবিটির দিকে তাকাতে বাধ্য হয়। আমি বছরের পর বছর ধরে যা শিখেছি তা হল, লোকেরা এমন কিছু দেখতে চায় না, যা খুব গ্রাফিক। ব্যক্তিকে আকর্ষণ করার জন্য ছবিতে এমন কিছু সৌন্দর্যবোধ বা কম্পোজিশন থাকতে হবে যাতে দর্শকবৃন্দকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে সক্ষম হয় । তাই এমনভাবে ছবি তোলার চেষ্টা করি যা অন্তরঙ্গ, এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের বিষয়বস্তুর মধ্যে নিয়ে আসে।

আপনি যখন দেখছেন যে দেশে সংকট চলছে, সংকট সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আমার মনে হয়, মানুষ এখন অনেক বেশি অন্তর্মুখী। আমি মনে করি মানুষের নিজস্ব সংকট রয়েছে এবং বিদেশে কী ঘটছে তা নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সম্ভাবনা কম। এটি একটি বড় সমস্যা কারণ এমন অনেক দেশ রয়েছে যারা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের ওপর নির্ভর করেছে। এখন ত্রাণ প্রদানকারী দেশগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষের আপনজন মারা গেলে সেটাই অগ্রাধিকার পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও মৃতের সংখ্যার দিকে তাকান। মানুষ বাইরের চেয়ে ঘরের দিকে মনোযোগ দেবে।

সময়ের সাথে সঙ্কটগুলি নথিভুক্ত করার পরে, এবং সেগুলি এত বছর ধরে চলতে দেখে, আপনার কি এখনও একই বিশ্বাস রয়েছে যা পূর্বে ছিল, যেমন মানুষের সচেতনতা বাড়ানো আসলে সামগ্রিক বিষয়কে পরিবর্তন করতে পারে?

সত্যি বলতে, আমি এটা নিয়ে সংগ্রাম করছি। প্রায়শই যে প্রশ্নটি পাই তা হলো: আপনি কেন ফিরে যাচ্ছেন যদি আপনাকে দু’বার অপহরণ করা হয়, গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়, আক্রমণ করা হয়? এবং আমার উত্তর হল মানুষকে দেখতে হবে এবং সচেতন হতে হবে এবং কী ঘটছে তা বুঝতে হবে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ক্ষমতার অবস্থানে থাকা লোকদের তথ্য এবং সরঞ্জামগুলির প্রয়োজন। আমি কি ভাবছি যে এখন তাই হয় কিনা? হ্যাঁ, সিরিয়ার যুদ্ধ হতাশাজনক। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমরা সিরিয়ার বাইরে চিত্র দেখেছিরাসায়নিক হামলা, আলান কুর্দি ঘুমন্ত শিশুর মতো তীরে ভেসে এসেছিল। আমরা বেসামরিক হতাহতের ঘটনা দেখেছি।

সিরিয়ায় যুদ্ধ কীভাবে চলছে তা আমি বুঝতে পারছি না। আমি তো এটির চারপাশে আমার মাথা পেতে দিতেও পারছি না। হ্যাঁ, এটা আমাকে বিরতি দেয়। হয়তো মানুষ পাত্তা দেয় না। আমি জানি না। আমাকে নিজেকে আশ্বস্ত করতে হবে যে নির্বিশেষে, এই ছবিগুলি তোলা এবং এই সময়ের একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড থাকা গুরুত্বপূর্ণ।

(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত জামায়াত
পরবর্তী নিবন্ধবন্যায় নারী ও শিশু সুরক্ষায় প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ