যুদ্ধদিনের গল্প

বিপুল বড়ুয়া | সোমবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

একটা ঘোরের ভেতর ছুটতে ছুটতে আসা। ময়নাজোনাব ও বিলু। সাথে তাদের কমান্ডার রেহান ভাই। একটু আগে এক পশলা ঝির ঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভারী হয়ে গেছে গায়ের রঙচটা জামা। বিলু কেমন যেনো জামার সপসপে ছোঁয়া বেশ বুঝতে পারে।

জনমানবশূন্য গাঁও গেরামের পথ। বাব্বা যা না কাদা মাখামাখি এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। পা খড়খড়ে দলা মাটির খোঁচায় তিতিয়ে উঠে। পা বাড়াতে হয় অনেক হিসাব করে।

রেহান ভাই একসময় খ্যাক খ্যাক করে কেশে উঠে। ফ্যাস ফ্যাসে গলা। তিনজনেই সচকিত হয়ে উঠে। কিছু একটা বলবেন রেহান ভাই। সবার কান খাড়া। বিড় বিড় করে উঠেন রেহান ভাই। ‘এখন সময় কতো বলাও তো যাচ্ছে না।’ ময়না, জোনাব চুপ মেরে থাকে।

রেহান ভাইমাঝ রাত হবে মনে হয়। দেখেন না লোকজনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। শেয়ালকুকুরের ডাকও নেই। সবাই ঝিম মেরে আছে।’ বিলু ছোট্ট জবাব দেয়।

মেঠো রাস্তার পাশে একটি পুরনো গাছের মোটাসোটা গুঁড়িতে হাতপা ছড়িয়ে বসে পড়ে তিন জন। রেহান ভাইয়ের শার্টের ভেতরে কাঁধে ঝোলা স্টেনটা যেনো বাইরে আসার জন্য কেমন যেনো উঁকিঝুঁকি মারছে। তিন জনের তিনটা আধ পুরনো রাইফেল। বিলুর হাতে মোটা থলেতে কটি গ্রেনেড।

ওরা রোয়াজাপাড়া ক্যাম্প হতে পথে নেমেছে সেই রাত নামার সাথে, ঘণ্টা চারেক তো হেঁটে এসেছেহাইকমান্ড থেকে খবর এসেছে হাদি হাটের প্রাইমারি ইশকুলে রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন চালাতে হবে শেষরাতে। দক্ষিণের হরেশপুর হতেও শফিক ভাই বড় সড় একটি দল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হয়তোবা এতক্ষণে নিমতলী এসে পড়েছে। নিমতলীর দক্ষিণের বাঁক ছাড়ালেই তবে হাদি হাট। ওরা সবাই মাঝরাতের শেষদিকে নিমতলী চৌরাস্তায় একত্র হবে। শেষরাতে অপারেশন রাজাকার ক্যাম্পে।

রেহান ভাই কথা বলেন। ‘দেখ, আমরা প্রায় নিমতলীর কাছাকাছি এসে গেছি। নিমতলীর পূর্বের দিঘির পাড়ে বসে শফিক ভাইয়ের গ্রুপের সাথে কথা বলে অপারেশনের সব ঠিক করে নেব।’

তিন জন বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে যায়রেহান ভাই আরও কী কী বলেন। সবাই বেশ সতর্কসামনে একটি বড় সড় অপারেশন।

কাদাভেজায় ওরা তিন জন রেহান ভাইয়ের মুখোমুখি। রেহান ভাইয়ের চোখ মুখ আলো আবছায়ায় দেখা যায় বেশ উদ্বিগ্ন। ভাবছেন রেহান ভাইরাজাকার ক্যাম্পের অপারেশন নিয়ে। ময়না ও জোনাব চুপচাপ বসে আছে।

একরাশ ভাবনা বিলুকেও পেয়ে বসে। কতোদিন এই নৌকো জীবন নিয়ে ভেসে বেড়ানো। বাড়ি হতে বেরিয়েছে সেই ক মাস। দু’তিনটি ক্যাম্পে হাড় খাটুনির ট্রেনিং নিয়ে এ গ্রুপ সে গ্রুপ হয়ে শেষপর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার রেহান ভাইয়ের গ্রুপে থিতু হয়ে বসা। কখনো এ গ্রুপসে গ্রুপের সাথে অপারেশনে অংশ নেওয়াযুদ্ধ করা।

আহা দেশআহা স্বাধীনতা সেই মরণপণ যুদ্ধ নেমে পড়া।

হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে তাড়াতে হবে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবেসোনার দেশ গড়তে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের রেসকোর্সের ভাষণ এখনো যেনো কানে বাজে বিলুর। ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রামজয় বাংলা।’ সেই মুক্তির সংগ্রামে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার সংগ্রামে আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিসেনারা। রেহান ভাইময়নাজোনাববিলুর মতো লাখো লাখো মুক্তিসেনা। তারা আজ যুদ্ধে যুদ্ধে মরিয়া, নেই কোনো পিছু টান, ঘর বসতের প্রিয় প্রাঙ্গণপ্রিয় মুখগুলো আজ কতো দূরে। কখন হায়েনা তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করবে তারা। কখন ঘরে ফেরবে? হয়তো বা আর ফেরাও হবে না ঘরে। কে জানে কোথায় কোন ভূমিশয্যা অপেক্ষা করছে পরম মমতায়। বিলুর ভাবনায় যেনো বিষাদের খানিকটা ছায়াও নামে।

হ্যান্ডটর্চের এক ছিটকে আলোয় সচকিত হয়ে ওঠে বিলু। রেহান ভাইহাতের ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছেন। বিলু এতোদিন কমান্ডার রেহান ভাইয়ের গ্রুপে থাকতে থাকতে বেশ বুঝে গেছে তার কর্মচাঞ্চল্যকর্তব্য সময়নিষ্ঠা। বিলু বুঝে ফেলেএবার রেহান ভাই অপারেশন নিয়ে কিছু বলবেন।

এবং মুখ খোলেন রেহান ভাই। সবার মুখোমুখি হয়ে বলে যান ফায়ার ওপেনের মুহূর্তকথা, গ্রেনেডের পিন খোলার সাবধানতা, কম্বিংএ যাওয়ার হিসাব নিকেশ, বডি হাইটের সতর্কতাক্রলিং করে সামনের অ্যাডভ্যান্স টিমকে এগিয়ে দিতে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ারের টুকিটাকি। অবাক হয়ে বিলু শোনে দেখে ভার্সিটির সেরা ছাত্রউচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে রেহান ভাই দেশের স্বাধীনতার জন্য কী আত্মনিবেদিতকোথায় বনবাদাড়ে মৃত্যুকে মুখোমুখি নিয়ে পা ফেলছেনতাদের সাথে এক হয়ে যুদ্ধ করছেন

একটা ছোট্ট মুখসিটি যেনো বাতাসে ভেসে আসে। রেহান ভাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়া ময়নাজোনাববিলুর। এবার এগোতে হবে। রেহান ভাইয়ের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তাই বলে। হয়তোবা শফিক ভাইয়ের গ্রুপ এতোক্ষণে দিঘির পাড়ে এসে পড়েছে। শেষ রাত ঝিম মেরে আছে ক জন মুক্তিসেনার গৌরবগাথার ইতিহাস লিখে রাখতে। রেহান ভাইয়ের নেতৃত্বে কাদাখোড়া পথ পেরিয়ে হাদি হাট অপারেশনে এগিয়ে যায় বিলুরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা-বাঙালি এবং বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধবিজয় দিবসের প্রত্যাশা