যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ আমার বাবা

রুবানা কাফি ঝর্ণা | সোমবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ

১১ ডিসেম্বর। গতবছর ঠিক এইদিনটা বাবাকে হারিয়ে ফেলার দিন। বাবা চলে যান পরপারে! ৮৮৮৯ বছর বাবা বেঁচেছিলেন এই পৃথিবীতে। আমার জীবনে অনেকগুলো সময় বাবাকে কাছে পেয়েছি। কিন্তু এই একবছরে একটা দিনও এমন যায়নি বাবার শূন্যতায় হাহাকার করে উঠেনি মন। বাবার শেষ সময়গুলোয় কাঙালের মতো হাহাকার করেছি বাবাকে ধরে রাখবার জন্য। মাথার ওপর থেকে স্নেহের ছাদখানা খসে পড়বার আশঙ্কায়। দিবানিশি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি, কিন্তু নিয়ম নিয়মই। চলে গেলো বাবা।

একটা দুরন্ত উচ্ছল সুন্দর শৈশব ও কৈশোর ছিলো আমাদের! নিয়মের মধ্যে থেকেও উচ্ছলতায় কোনও বাধ সাধেনি সেই শৈশব, কৈশোর। আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, মধ্য জীবন এই সবকটা কালেই আমার হিরো আমার বাবা! মেয়েরা বাবার বা বাবারা মেয়েদের কেন এতো প্রিয় হয় জানি না। শুধু জানি বাবার জবজবে ঘামে ভেজা গেঞ্জিটাতেও কোনও গন্ধ ছিলো না। আমার চিকিৎসক বাবা ডা. এম. . কাফি ছিলেন আপাদমস্তক সরল সাদামাটা একজন মানুষ। সারল্যতা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমার ভীষণ ভালো মানুষ বাবাটা সারাজীবন সরকারিআধা সরকারি চাকরি করেছেন। পোশাক আশাক ও মনমানসিকতায় অত্যন্ত স্মার্ট আমার বাবার জীবনে তেমন কোনও ভোগ বিলাস ছিলো না। ছিলো একদম অন্য মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের মতন।

নীতিনৈতিকতায় দৃঢ আমার বাবার চরিত্রের অন্যতম আকৃষ্ট করবার মতন গুণটি ছিলো মাবাবা, ভাইবোনদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা এবং ভালোবাসা। যা আমাদের পরিবারটির বন্ধনকে যৌথ পরিবারের তকমা দিয়েছে আজীবন।

আমার বাবার যে গুণটি বাবাকে অন্য মানুষ এবং অন্য চিকিৎসক থেকে আলাদা করে তা হলো ভীষণ রকম মানবিক এবং পরোপকারী ছিলেন আমার বাবা। পাশের ফ্ল্যাটে কেঁদে উঠা বাচ্চার কান্নাও বাবা সহ্য করতে পারতেন না। ডেকে জানতে চাইতেন, বাচ্চা কাঁদছে কেন? রোগীর নিজের প্রতি অবহেলার কারণে রোগের প্রকোপ বেড়ে গেলে রীতিমতো উচ্চ স্বরে বকাবকি করতেন রোগীকে। চিকিৎসাধীন আত্মীয় স্বজন বা পরিচিতজনরা হাসপাতালে ভর্তি হলে অস্থির হয়ে যেতেন তার সুস্থতা নিয়ে। মানুষের অন্তরকে ছোঁবার মত অসামান্য মমতা দিয়ে গড়া ছিলো আমার বাবার মন।

নির্দিষ্ট সামর্থ্যের মধ্যে থেকেও পারতপক্ষে সন্তানদের কোনও ইচ্ছেকে অপূর্ণ রাখেননি আমার বাবা। সময়ের সবচেয়ে ভালো সাবান, ভালো ক্রিম আমাদের দখলে থাকতো। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকহানাদার বাহিনীর রকেট লঞ্চারের আঘাতে আহত হন আমার বাবা। এবং জীবনের অন্তিম দিনটি পর্যন্ত রকেট লঞ্চারের স্পিন্টারটি বহন করেছেন নিজের শরীরে। (নিশ্চিত জীবন ঝুঁকির কারণে অপারেশন করা সম্ভব হয়নি।) আমার বাবার কষ্ট আমরা দেখেছি। কখনো পা গুটিয়ে বসতে পারেননি। এমনকি নামাজও পড়তে হতো ডান পা টা মেলে রেখে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় মুক্তিযুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রেখে বিভিন্ন ক্যাম্পে ক্যাম্পে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটিগুলোতে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়া আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে আফসোস করতে দেখিনি কখনো।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসামপ্রদায়িক রাজনীতির অনুসারী ছিলেন আমার বাবা। বাবা নামটার মধ্যে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ থাকে যা পৃথিবীর সব সম্পর্ক থেকে একদম ভিন্নতর অনুভূতির জন্ম দেয়। আমার বাবা আমার দেখা সময়ের শ্রেষ্ঠ বাবা। আদর শব্দটার একটা যথার্থ প্রতিশব্দ আমার বাবা! যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ আমার বাবা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশি সমর্থকদের ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের বিজয় বই উৎসব নগরে অনন্য আয়োজন